আজকের দিনটি এই দেশে উদ্যাপনের ঘনঘটা। প্রধানমন্ত্রীর দফতর হইতে শুরু করিয়া পাড়ার ক্লাব, সর্বত্রই স্মরণ-উদ্যাপনের ধুম পড়িবার দিন। মহাত্মা গাঁধীর জীবন ও বাণীর জয়গান, মন্ত্রীর মুখে ধ্বনিত আত্মতৃপ্তি— কী ভাবে দেশকে তাঁহারা গাঁধীর প্রদর্শিত পথে চালিত করিতেছেন। কে বলিতে পারে, গাঁধীর চশমা, ডান্ডির লাঠি ইত্যাদির সহিত আরও নূতন প্রতীকের প্রবর্তন হইবে, অহিংসার জয়গান মুখে মুখে ফিরিবে। আর এই সবের ঠিক পাশেই মানুষের প্রতি মানুষ আরও কত হিংস্র হইয়া উঠিতে পারে, তাহার প্রতিযোগিতায় ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের দিকে ধাবিত হইবে। গরিবের প্রতি ধনবান, দলিতের প্রতি উচ্চবর্ণ, সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরু, নারীর প্রতি পুরুষ, অকথনীয় ও অভাবনীয় হিংস্রতা নব নব রূপে উদিত হইবে। পুলিশের মারে নিথর দেহের উপর পুলিশের ভয়ানক প্রহার ও নির্যাতন নামিয়া আসিবে— যেমন হইল অসমে— সাংবাদিকের রূপে গাঁধীরই কোনও দেশবাসী সেই নিস্পন্দ দেহের উপর পদাঘাত করিয়া ভিডিয়ো তুলিবেন। তথ্যে জানিতে চাহিবার অপরাধে মানবাধিকার কর্মীকে এক গুলিতে নিহত হইতে হইবে— যেমন হইল বিহারের চম্পারণে। ত্রিশ জন পুরুষ মিলিয়া একত্রে একটি ১৫ বৎসরের মেয়েকে অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতায় ধর্ষণ করিবে— যেমন হইল মহারাষ্ট্রে। দলিত কিশোর-কিশোরীকে মুখে কালি মাখাইয়া গলায় জুতার মালা ঝুলাইয়া বস্ত্রহীন হাঁটাইয়া গণ-জুতামারা উৎসব হইবে— যেমন হইল উত্তরপ্রদেশে। এই সবই মাত্র এক সপ্তাহের সংবাদ। সুতরাং, সাধারণ ঐকিক অঙ্কের সূত্রই বলিয়া দিবে ভারত আমার ভারতবর্ষ কোন তলে দাঁড়াইয়া মহাত্মা গাঁধীকে স্মরণ করিতেছে। স্মরণের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই বলিয়া দেওয়া প্রয়োজন যে, উপরের একটি ক্ষেত্রেও উপযুক্ত শাস্তি মিলিবে না, কেননা প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিগ্রহকারী হয় সরাসরি সরকারি পুলিশ, নয়তো সরকারের বরাভয়প্রাপ্ত সামাজিক গোষ্ঠী। হিংসা এখন দেশের সমাজে ও রাষ্ট্রের শাসনে এমনই স্বাভাবিকীকৃত যে, ইহা লইয়া তদন্ত-শাস্তিও ব্যতিক্রমী হইয়াছে, প্রতিবাদ-আন্দোলনও অপ্রয়োজনীয় বলিয়া গণ্য হইয়াছে।
মহাত্মা গাঁধী বিশ্বাস করিতেন, ভারতবর্ষের সমাজ স্বাভাবিক ভাবেই অহিংসার পথে চলিতে অভ্যস্ত, তাই তাহার উপর ভিত্তি করিয়া একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা খুবই সম্ভব। প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের ভারতীয় ইতিহাস তাঁহার এই বিশ্বাসে সংশয়ের আলো ফেলিয়াছিল, তিনি নিজেও হিংসার বিস্ফোরণ দেখিতে দেখিতে ব্যথিত উদ্বেগে প্রায় আত্ম-নির্বাসনে চলিয়া গিয়াছিলেন। প্রাচীন ভারতের সমাজ লইয়া গবেষণা করিতে গিয়া ইতিহাসবিদ উপেন্দ্র সিংহ সম্প্রতি তাঁহার বইতে দাবি করিয়াছেন, পুরাকালেও যে ভারতে হিংসা রীতিমতো পরিব্যাপ্ত ছিল, তাহার প্রমাণ বিস্তর, সুতরাং গাঁধীর এই কথাটির কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া দুষ্কর। এখনও এই প্রশ্ন আরও গবেষণা ও বিতর্কের প্রতীক্ষায়। তবে এই কথা ঠিক যে, ভারতীয় সমাজের স্বভাবত শান্তির যে ধারণা মহাত্মা গাঁধী দিয়াছেন, সাম্প্রতিক সময়কালে দাঁড়াইয়া তাহার উপর বিশ্বাস রাখা অসম্ভব রকমের দুরূহ। এই কারণে গাঁধীর অহিংসা তত্ত্বের ভিতরে প্রবেশ করিয়া দার্শনিক অনুসন্ধানের প্রয়োজনটিও দিনে দিনে বাড়িতেছে। কেবল প্রতীক ও স্লোগানের বাহিরে মহাত্মাকে লইয়া চর্চার প্রয়োজন প্রতি দিন বেশি করিয়া জরুরি হইতেছে। মহাত্মার মধ্যেও মানসিক দ্বন্দ্ব ছিল। এক দিকে নিজের সত্যের প্রতি আগ্রহ, এবং অন্য দিকে, দুর্বলকে সবলের বলের সামনে রক্ষা করিবার তাগিদ— এই জাঁতাকলের তিনিও বহু ক্ষেত্রে দিশাহারা বোধ করিয়াছেন। এই সব সঙ্কটকেও আজ নূতন করিয়া স্মরণ করা প্রয়োজন। বর্তমানের বিকারগ্রস্ত সময় হইতে উদ্ধারের পথ খুঁজিতে তিনি হয়তো আবার নূতন করিয়া সহায়ক হইতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy