Advertisement
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
mahatma gandhi

উত্তর মিলে নাই

যদি কেহ বলেন, ভারতের আর্থিক নীতি রচনায় গান্ধী পরাজিত, সেই সিদ্ধান্তকে মিথ্যা বলিয়া উড়াইয়া দিবার উপায় নাই।

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:২৪
Share: Save:

একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাজ্য পৃথিবীকে শৃঙ্খলিত করিয়া রাখিয়াছে। ত্রিশ কোটি লোকের একটি দেশ যদি একই ধরনের অর্থনৈতিক শোষণের পথে চলে, সে পৃথিবীকে পঙ্গপালের ন্যায় রিক্ত করিয়া দিবে— ১৯২৮ সালে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লিখিয়াছিলেন গান্ধীজি। এই লেখাতেই ছিল তাঁহার সভয় উক্তি: “ঈশ্বর না করুন, ভারত যেন পশ্চিমের ধাঁচে শিল্পায়নে প্রবৃত্ত না হয়।” প্রায় এক শতাব্দী পরে, সেই অনন্য মানুষটির মর্মান্তিক বিদায়ের দিনে এই কথাগুলি স্মরণ করিবার কারণ আছে। বিশ্ববাসী জানেন, ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গান্ধীজির প্রার্থনা তাঁহার ঈশ্বর পূরণ করেন নাই, জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে স্বাধীন ভারত তাহার আর্থিক নীতিতে ‘পশ্চিমি’ শিল্পের প্রসারকেই উন্নয়নের প্রধান উপায় বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিল, সেই মূল নীতি আজও অপরিবর্তিত। বস্তুত, গান্ধীবাদী অর্থনীতি ভারতে কোনও দিনই বড় আকারের প্রতিস্পর্ধী উন্নয়নের প্রকল্প হিসাবে স্বীকৃত হয় নাই, ইতস্তত তাহার আদর্শ অনুসরণ করিয়া কিছু কিছু স্থানীয় উদ্যোগ হইয়াছে, অনেক ক্ষেত্রে তাহারা সীমিত পরিসরে সফলও হইয়াছে, কিন্তু জৈব কৃষি এবং কুটিরশিল্পের ভিত্তিতে স্বনির্ভর গ্রামসমাজ জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতি আনিবে, এমন ধারণা সীমিত পরিসরের ব্যতিক্রমী চিন্তা হিসাবেই থাকিয়া গিয়াছে। যদি কেহ বলেন, ভারতের আর্থিক নীতি রচনায় গান্ধী পরাজিত, সেই সিদ্ধান্তকে মিথ্যা বলিয়া উড়াইয়া দিবার উপায় নাই।

কিন্তু উপায় নাই তাহাকেই চূড়ান্ত এবং সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করিবারও। কেন? সেখানেই তাঁহার উদ্ধৃত কথাগুলির প্রাসঙ্গিকতা, যে প্রাসঙ্গিকতা সমকালীন দুনিয়ায় প্রভূত পরিমাণে বাড়িয়া গিয়াছে। পশ্চিমি ‘সভ্যতা’ সম্পর্কে গান্ধীজির বহুবিধ আপত্তি ও অভিযোগ ছিল, কিন্তু এখানে তিনি ভারতকে ক্ষুদ্র দ্বীপরাজ্য ইংল্যান্ডের অনুসরণ করিতে বারণ করিতেছেন একটি বিশেষ এবং নির্দিষ্ট কারণে— যন্ত্রনির্ভর বৃহৎ শিল্পের ভিত্তিতে নগরকেন্দ্রিক উন্নয়নের ওই পথটি প্রকৃতি এবং পরিবেশের ভারসাম্যকে বিনষ্ট করিয়া দেয়, ইকোলজি বা বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয় ডাকিয়া আনে, সেই বিপর্যয়কেই তিনি পঙ্গপালের আক্রমণের সহিত তুলনা করিয়াছেন। তাঁহার মতে, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব আর্থিক অগ্রগতির যে পথ দেখাইয়াছে, তাহা এই বিপর্যয়ের পথ। সমস্যা কেবল প্রযুক্তি এবং বৃহদায়তনের নহে, তাহার ভিত্তিতে আধুনিক ‘উন্নয়ন’-এর যে ধারণা প্রচলিত হইয়াছে তাহা নিজেই সমস্যার আকর, কারণ তাহা প্রকৃতির সম্পদকে যথেচ্ছ এবং বাধাবন্ধহীন আহরণ করিয়া চলে, প্রকৃতি তাহার নিকট অন্তহীন এবং সীমাহীন শোষণের উপকরণমাত্র। সেই অনন্ত এবং অখিল ক্ষুধা মিটাইতে গিয়া পৃথিবী সর্বস্বান্ত হইবে, ইহাই গান্ধীজির দৃঢ় বিশ্বাস। এই সূত্রেই উচ্চারিত হইয়াছিল তাঁহার অন্যতম প্রসিদ্ধ মন্তব্য: সকলের প্রয়োজন মিটাইবার সামর্থ্য এই গ্রহের আছে, সকলের লালসা মিটাইবার সাধ্য তাহার নাই।

একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে ফিরিয়া আসিলে গান্ধীজি যে পৃথিবীর সম্মুখীন হইবেন, তাহা আক্ষরিক অর্থে প্রলয়ের দিন গনিতেছে। সেই প্রলয়ের সম্ভাব্য চিত্রগুলির নিকট পঙ্গপালের হানাদারির দৃশ্য অকিঞ্চিৎকর। এই গ্রহকে দেখিয়া তিনি অনায়াসে উপলব্ধি করিতেন যে তাঁহার আশঙ্কা সত্য হইয়াছে, মানুষের ‘সভ্যতা’ তাহাকে যে বিপুল ক্ষমতা দিয়াছে তাহার দাপটে গ্রহের অস্তিত্ব বিপন্ন; ‘সভ্য’ মানুষের যে অপরিসীম চাহিদা প্রতি মুহূর্তে দুর্বার গতিতে বাড়িয়া চলিয়াছে তাহা পূরণ করিতে গিয়া অরণ্য নিঃশেষিত, জমি অন্তঃসারশূন্য, নদী শীর্ণ, সমুদ্র দূষিত, ভূ-জল ফুরাইয়া আসিতেছে, বাতাসে তীব্র বিষ। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চলিয়া আসিতেছে, যে পথ উন্নয়ন ও অগ্রগতির একমাত্র পন্থা হিসাবে বন্দিত হইয়া আসিতেছে, তাহা যে প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বাস্থ্য রক্ষায় অপারগ, মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখিবার কোনও ভরসাই যে সে আর দিতে পারিতেছে না, এই সত্য মানিয়া লইবার জন্য আজ আর গান্ধীবাদী হইবার প্রয়োজন নাই। মানুষের ভোগের সীমা কোথায় টানা উচিত, এই প্রশ্নটি মাত্র কয়েক দশক আগেও উন্নয়নের অভিধানে নিষিদ্ধ ছিল— কেবল বাজার অর্থনীতি শাসিত দুনিয়ায় নয়, রাষ্ট্র-কবলিত তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক গোলার্ধেও। এখন মানুষ নামক প্রজাতির চলিবার পথে সেই প্রশ্ন উত্তরোত্তর বৃহৎ হইতে বৃহত্তর আকার ধারণ করিতেছে। পৃথিবী আপনাকে বাঁচাইতে গান্ধীর পথে আসিবে, তাহার কিছুমাত্র নিশ্চয়তা নাই। কিন্তু তাঁহাকে পরাজিত বলিয়া বিদায় করিবে, সাধ্য কী?

অন্য বিষয়গুলি:

mahatma gandhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy