বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে কি সংবিধানকে অন্তর্ভুক্ত করা বিধেয়? প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে প্রশ্নটি উঠিয়াছে। প্রশ্নটির এক কথায় উত্তর সম্ভব— হ্যাঁ। স্কুলশিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় ভবিষ্যতের নাগরিককে তাহাদের জীবনের বিভিন্ন দিকের অর্থ অনুধাবন করিতে সাহায্য করা, তবে ত্রিকোণমিতির সূত্র অথবা তুন্দ্রা অঞ্চলের জলবায়ুর তুলনায় সংবিধান সম্বন্ধে সচেতনতার গুরুত্ব প্রশ্নাতীত রকম বেশি। তাহার প্রত্যক্ষ কারণ হইল, স্বাধীন রাষ্ট্রে নাগরিকের কোন অধিকার স্বীকৃত, সেই বিষয়ে সংবিধান প্রবর্তনের সাত দশক পরেও দেশের অধিকাংশ মানুষ নিতান্ত অজ্ঞ। এই অজ্ঞানতা শাসকদের পক্ষে বিলক্ষণ সুবিধাজনক— কারণ, অধিকার সংক্রান্ত জ্ঞানই ‘প্রজা’কে ‘নাগরিক’ করিয়া তুলিতে পারে। শাসক যখন নাগরিকের অধিকার খর্ব করে, তখন নাগরিকের পক্ষে যদি সেই অন্যায়ের প্রকৃত স্বরূপ বোঝা সম্ভব হয়, তখন শাসকের কাজটি কঠিনতর হয়। যে নাগরিক প্রত্যক্ষ ভাবে সেই অন্যায়ের শিকার নহেন, তাঁহার চোখেও শাসকের অন্যায্যতা প্রকট হইলে নাগরিকের সহজাত নৈতিকতার বোধ সরকারের বৈধতাকে প্রশ্ন করিতে পারে। নাগরিকের নিকট বৈধতা হারাইবার ভয়েই বহু ক্ষেত্রে শাসকরা সংযত হইবেন, এমন আশা নিতান্ত অলীক নহে।
কিন্তু, এই প্রত্যক্ষ কারণই একমাত্র নহে। সংবিধান বস্তুটিকে একটি চুক্তিপত্র হিসাবে দেখা সম্ভব— রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মধ্যে রচিত চুক্তি। শাসকরা নাগরিকদের শাসন করিবেন বটে, কিন্তু সেই শাসন স্বেচ্ছাচার নহে— নাগরিকদের সম্মতিক্রমে রচিত সূত্র অনুসারেই সেই শাসন পরিচালিত হইবে। ভারতীয় সংবিধানের উপক্রমণিকায় জানানো হইয়াছিল, “উই, দ্য পিপ্ল অব ইন্ডিয়া”— আমরা ভারতীয় নাগরিকেরা— নিজেদের এই সংবিধান প্রদান করিতেছি। উপর হইতে চাপাইয়া দেওয়া নহে, এই সংবিধান ভারতের নাগরিকরা নিজেদের জন্য রচনা করিয়াছিলেন। ইহাকে আলঙ্কারিক অতিকথন বলিয়া উড়াইয়া দিলে সংবিধানের মূলমন্ত্রটিকেই অস্বীকার করা হয়। এই রচনার প্রক্রিয়াটি এককালীন নহে। সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব, এবং সেই কাজটি হইয়া থাকে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের সহিত নাগরিকের চুক্তিপত্র রচনার কাজটি চলিতেছে। সেই প্রক্রিয়ায় শুধু উচ্চশিক্ষিত, উচ্চকোটির নাগরিকরাই অংশগ্রহণ করিলে তাহা অসম্পূর্ণ থাকিবে— একশত চল্লিশ কোটি নাগরিকের প্রত্যেকের অধিকার স্ব-শাসনের চুক্তিপত্র রচনার প্রক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার।
গণতন্ত্র কথাটি তাহার প্রকৃত অর্থে উপনীত হয় তখনই, যখন আলোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়। শুধু সংসদ ভবনের অভ্যন্তরে আলোচনা নহে; শুধু পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠায়, অথবা বিদ্বৎসমাজের সভাগৃহে আলোচনা নহে— সমাজের সর্বস্তরে সেই আলোচনা চলা বিধেয়। তাহার ভিত্তি হইতে পারে সংবিধান সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা। স্বাধীন রাষ্ট্রে নাগরিকের যে অধিকার স্বীকৃত, তাহা ব্যবহারিক ভাবে পাওয়া যাইতেছে কি না; অথবা, এখনও যে অধিকারের স্বীকৃতি নাই, তাহা আদায় করা আদৌ প্রয়োজন কি না— নাগরিকের জীবনে এই প্রশ্নগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। এই গুরুত্বের কথা নাগরিককে স্মরণ করাইয়া দিতে পারে সংবিধান সম্বন্ধে সচেতনতা। বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে সংবিধানের অন্তর্ভুক্তিই তাহার প্রথম ধাপ হইতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy