সবার উপরে মানুষ সত্য? অতিমারি-কালে ইহার নিশ্চিত জবাব দেওয়া হয়তো সমীচীন হইবে না, তবু জগতে শ্রেষ্ঠ আসনটি অক্ষুণ্ণ রাখিতে তাহার নিরন্তর প্রচেষ্টা যে জারি আছে, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায়। করোনাভাইরাস যত নূতন রূপে প্রাদুর্ভূত হইতেছে, ততই তাহাকে ঘায়েল করিতে নিত্যনূতন উপায় বাহির করিতেছে মনুষ্যজাতিও, তাহাতে স্বয়ং আহত হইয়াও। ইদানীং ওমিক্রন ভেরিয়্যান্ট সমগ্র বিশ্বকে ফের ত্রস্ত করিতেছে, এবং তাহা ঠেকাইতে কেবলমাত্র টিকাহীন নাগরিকদের জন্য লকডাউন ঘোষণা করিয়াছে জার্মানি। ইহাতে এক ঢিলে দুই পাখি মরিবে— সংযোগ কমিবার ফলে সংক্রমণ হ্রাস পাইবে, এবং টিকাগ্রহণের জন্য জনতার আগ্রহ বাড়িবে। অতিমারিতে স্বাস্থ্য ব্যতিরেকেও শিক্ষা, অর্থনীতি ইত্যাকার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত লড়িতে হইতেছে। অতএব একটি চাল দিয়া দুইটি রণক্ষেত্রে আগাইয়া যাইবার উপায়টি যাঁহাদের মস্তিষ্কপ্রসূত, তাঁহাদের বুদ্ধির প্রশংসা করিতে হয়। কেহ কেহ মানবাধিকারের যুক্তিতে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করিতেছেন। তাঁহারা যথার্থই আপনার অধিকারের কথা ভাবিতেছেন, কিন্তু অবশিষ্টাংশের অধিকারের কথা ভাবিতেছেন না। বুঝিতে হইবে, মহামারির ন্যায় বিপর্যয়ের কালে যুক্তিক্রম কিছু ভিন্ন হয়, এই কালে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতার বাহিরেও একটি পরিসর থাকে, কেননা ব্যক্তির সিদ্ধান্ত তখন তাহার সহিত বিযুক্ত সমষ্টিকেও বিচলিত করে। যাঁহারা টিকা লইবেন না, তাঁহারা শুধু নিজেদের নহে অপরের বিপদও ডাকিয়া আনিবেন। সর্বার্থে মনুষ্যসমাজের সুবুদ্ধিই তাই এখন ভরসা।
ভারতে বসিয়া যদিও এই রূপ অভিনব ও কার্যকর চিন্তা আকাশকুসুম ঠেকিতে পারে। যে দেশে অদ্যাবধি ৪২ শতাংশ নাগরিক একটি ডোজ়ও পান নাই, সেখানে টিকাহীনদের আলাদা ভাবে নিয়ন্ত্রণ করিবার কথা ভাবাও যায় না। বস্তুত, ভারতে টিকাকরণ লইয়া সঙ্কটের শেষ নাই। এক দিকে ভারত হইতে রফতানিকৃত টিকার জোরে বহু দেশে টিকাকরণে অগ্রগতি দেখা গিয়াছে (কেবলমাত্র ভারতীয় সহায়তায় দেশের ৬০ শতাংশ নাগরিককে একটি ডোজ় দিতে সমর্থ হইয়াছিল ভুটান সরকার), অন্য দিকে সেই একই সময়ে দ্বিতীয় ঢেউ এবং টিকার আকালে মৃত্যুমিছিল ঘটিয়াছিল এই দেশে। এখন আবার টিকাকরণ যাহা হইতেছে, তাহা অপেক্ষা শত গুণ প্রচার ও বিজ্ঞাপন হইতেছে। স্মরণে থাকিবে যে, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদল, এমনকি বিরোধী নেতাদের উপর্যুপরি সতর্কবাণী সত্ত্বেও টিকাকরণের ক্ষেত্রে সরকারি অবহেলার প্রমাণ যথেষ্টই। টিকাকরণের গতি কিংবা পরিসর, উভয় ক্ষেত্রেই আরও উদ্যোগের জায়গা ছিল। বিশেষ করিয়া আঠারো বৎসরের নীচে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনও টিকা না পাইয়া প্রতি দিনের বিপন্নতায় বাঁচিতেছে, তাহার পর টিকা লইয়া কেন্দ্রীয় সরকারের বাহাদুরি প্রকাশ একান্ত অশোভন। আমেরিকা ও ইউরোপের সকল নীতিই যে উত্তম কিংবা কার্যকর, তাহা নহে। কিন্তু তাহাদের কাছ হইতে একটি মূল্যবান শিক্ষা ভারত লইতে পারে। সমগ্র নাগরিক সমাজ সম্পর্কে দ্রুত ব্যবস্থা করিবার বাধ্যবাধকতাটি উপলব্ধি করিতে পারে। কী ভাবে সংক্রমণ ঠেকানো যায়, তাহা লইয়া যখন সে সকল দেশে নানা অভিনব ভাবনার স্ফুরণ— ভারত বহু পিছনে পড়িয়াও আত্মগৌরবে মত্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy