কেহ ইটভাটায়, কেহ বিড়ি বাঁধায়, কেহ পশুচারণে, কেহ বা গৃহনির্মাণে। বিগত দেড় বৎসরে অতি দরিদ্র স্কুলশিশুদের একটি অংশ এমন সব পেশার সহিত জড়াইয়া পড়িতেছে, শৈশবের সহিত যাহার সম্বন্ধ না থাকাই বাঞ্ছনীয়। বস্তুত, একটি কল্যাণরাষ্ট্রে কি শিশুদের কোনও ভাবেই অর্থ উপার্জনের উপায় খুঁজিবার কথা? কিন্তু, ইহাই বাস্তব। এহেন শিশুদের জন্য শিশু শ্রমিক স্কুল-এর ব্যবস্থা আছে। স্কুলে গেলে মিড-ডে মিলের সহিত তাহাদের জন্য বরাদ্দ কয়েকশো টাকা ভাতা। কিন্তু, অতিমারি-পর্বে শুধু পুরুলিয়া জেলাতেই ৮৯টি শিশু শ্রমিক স্কুল বন্ধ হইয়াছে, পুরাতন ‘পেশা’য় ফিরিয়াছে শিশুরাও। তদুপরি, বিভিন্ন গরিব পরিবার লকডাউনে রোজগার হারাইবার ফলে শিশুদের অর্থ উপার্জনের তাগিদটিও বৃদ্ধি পাইয়াছে। অভিজ্ঞতা বলিবে, যাহারা এক বার রোজগারের জন্য স্কুলব্যবস্থা হইতে বাহির হইয়া গেল, তাহাদের ফিরিবার পথটি সহজ নহে। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে যাহারা লেখাপড়া বজায় রাখিতে পারিয়াছে— অনলাইন বা অফলাইন বা মিশ্র মাধ্যমে— তাহাদের অধিকাংশেরই পারিবারিক সামর্থ্য আছে। কিন্তু যাহাদের নাই, তাহাদের কী হইবে? সেই দায়িত্ব তো রাষ্ট্রকে লইতেই হয়।
গোড়াতেই বুঝিতে হইবে, এই পরিবর্তিত অবস্থায় কোনও কার্যক্রমকেই আর ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া গণ্য করিলে চলিবে না— অনলাইন ক্লাস তো নহেই, এমনকি ক্লাসঘর খুলিলেও নহে। শিক্ষকেরা জানাইতেছেন, দীর্ঘ লকডাউন-পর্ব অনেক কিছুই অপরিবর্তনীয় রূপে পাল্টাইয়া দিয়াছে। প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া, যাহাদের স্বগৃহে লেখাপড়া চর্চার অভিজ্ঞতা নাই, তাহাদের পক্ষে ক্লাসঘর বিশেষ রূপে প্রয়োজনীয়, উহা শিক্ষার পরিবেশ গড়িয়া তোলে। গৃহবন্দিত্বে শিক্ষাঙ্গনের সহিত বিচ্ছিন্নতা তাহাদের লিখিবার ও পড়িবার ক্ষমতা ভুলাইয়া দিয়াছে; কাড়িয়া লইয়াছে ভাবিবার, জানিবার ও শিখিবার উৎসাহ। বস্তুত, বহু পড়ুয়াই যে চলতি আয়োজনের সহিত খাপ খাওয়াইতে পারিতেছে না, তাহা প্রশ্নাতীত। এমতাবস্থায় শুধু বিকল্প ব্যবস্থা করিয়া দায়িত্ব সারিতে পারে না রাষ্ট্র— সেই বন্দোবস্ত কার্যকর করিতেও সমরূপে উদ্যোগী হইতে হয়। যে শিশুরা লেখাপড়ায় আগ্রহ হারাইল, তাহাদের ফের শিক্ষামুখী করিয়া তোলা অবশ্যকর্তব্য।
এই উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদি এবং বহুবিধ। যাহারা বর্তমান ব্যবস্থায় তাল মিলাইয়া চলিতে পারিতেছে না, হয়তো অদূর ভবিষ্যতেও পারিবে না, তাহাদের জন্য রাষ্ট্রকে অপেক্ষা করিতে হইবে, অন্তত অর্থনীতির অবস্থা স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত। সেই শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় ধরিয়া রাখিবার উদ্যোগ বহুমুখী হওয়া বিধেয়। কাহারও জন্য নৈশ স্কুল, কাহারও করোনা-কালের পাঠ্যক্রমটুকু শিখিয়া লওয়া, কাহারও বা কিছু অর্থসহায়তা। অর্থাৎ, প্রতিটি শিশুর নিকট যথার্থ ভাবে শিক্ষার আলো পৌঁছাইয়া দিবার জন্য যতখানি পথ হাঁটিতে হয়, ততখানিই অতিক্রম করিতে হইবে এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। সঙ্কট যে হেতু বহু চেহারা লইয়াছে, অতএব কোনও এক প্রকারের বন্দোবস্ত সকলের জন্য উপযুক্ত হইবে না। এইখানে রাষ্ট্রের মূল একটি প্রতিজ্ঞা— প্রতিটি শিশুরই বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক ভাবে শিক্ষা পাইবার অধিকার আছে— স্মরণে রাখিতে হইবে। উহাই, সর্বার্থে, লেখাপড়ার মূল্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy