ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) লেনিনের জন্মদিন পালন করেছে, এটা নিতান্তই গতানুগতিক ব্যাপার। কিন্তু এই বছরে তার সঙ্গে মিলেছে আর একটি জন্মদিন। সেটি ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’-এর। অতিমারির সঙ্কটপর্বে দলের তরুণদের উদ্যোগে তৈরি এই সংগঠন বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যে ভূমিকা পালন করেছে, তা কেবল স্মরণীয় নয়, তা এক গৌরবময় ইতিহাস। লেনিনের জন্মদিনে সিপিআইএম এই ইতিহাসকে স্মরণ করেছে এবং স্বেচ্ছাসেবীদের লাল সেলাম জানিয়ে তাঁদের দৃষ্টান্তকে দলের পুনরুজ্জীবনের রসদ হিসাবে চিহ্নিত করেছে, এতে লেনিন অখুশি হতেন না। পুনরুজ্জীবনের অন্য রকম রসদও সম্প্রতি এই দলের ভাণ্ডাগারে জমা পড়েছিল, যখন বালিগঞ্জ বিধানসভার নির্বাচনে এক বছরের মধ্যে তারা ৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে উঠে এসেছিল। এই ‘বৃহৎ উল্লম্ফন’-এ দলীয় সদস্য ও সমর্থকরা স্বভাবতই পুলকিত বোধ করেছিলেন। তার আগে পুরভোটেও দলের ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র কিছু লক্ষণ তাঁদের প্রাণে আশার মুকুল জাগিয়েছিল। তাতে অন্তত পুরনো নৈরাশ্য কিছুটা দূর হয়ে থাকলেও তার গুরুত্ব আছে। গুরুত্ব কেবল দলের পক্ষে নয়, রাজ্যের পক্ষেও। এই রাজ্যের রাজনৈতিক ছবিটা যা দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ মা যা হইয়াছেন, তাতে বিরোধী দলের শক্তি বৃদ্ধি খুবই জরুরি। গণতন্ত্রের স্বার্থেই জরুরি। জোরদার বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র বাঁচে না, এই অত্যন্ত মামুলি সত্যটি মনে রাখলেই সেটা বোঝা যায়। বিজেপি নামক বস্তুটির অন্য সমস্ত গুণাবলির কথা বাদ দিলেও, পশ্চিমবঙ্গে যথার্থ বিরোধী দল হয়ে ওঠার কোনও যোগ্যতাই যে সে রাখে না, সেই সত্য তারা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছে। কংগ্রেস ন যযৌ ন তস্থৌ। আর সব কিছু ছেড়ে দিলেও শুধু এই জন্য বামপন্থীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
এবং, এই বাস্তবের সূত্র ধরেই উঠে আসে গভীরতর একটি চিন্তা। পশ্চিমবঙ্গের সমাজে— নাগরিক সমাজে এবং বৃহত্তর লোকসমাজে— ক্লেদ, গ্লানি, নষ্ট শসা, পচা চালকুমড়োর বীজ অনেক জমেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে যদি তার পঙ্কশয্যা থেকে টেনে তুলতে হয়, তবে তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন যথার্থ জনসংযোগের। জনসংযোগ মানে সভা ডেকে মাইক ভাড়া করে ভাষণ দেওয়া নয়, গলা এবং গাল ফুলিয়ে স্লোগান কীর্তন নয়, জনসংযোগ মানে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের সঙ্কটে সহায় হওয়া, তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে সরব ও সক্রিয় হওয়া, সেই অধিকার আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণ ও সংগঠিত উপায়ে শাসকের উপর চাপ সৃষ্টি করা। এই কাজ কেবল একটি বিশেষ দলের বা সংগঠনের নয়, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সকলের। বৃহৎ অর্থে এ-কাজ স্বেচ্ছাসেবীর কাজ, কারণ যথার্থ স্ব-ইচ্ছাই এমন উদ্যোগের প্রকৃত চালিকা শক্তি হতে পারে, উপর থেকে দলীয় নির্দেশ বা নেতানেত্রীর অনুপ্রেরণা দিয়ে সত্যকার সামাজিক আন্দোলন হয় না।
এবং সেই কারণেই এই ধরনের উদ্যোগের সার্থকতার আর একটি বড় শর্ত হল কথোপকথন। পশ্চিমবঙ্গে সেই শর্তের গুরুত্ব এখন অপরিসীম। এই সর্বগ্রাসী অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে এক বিরাট আকারে সামাজিক সংযোগ গড়ে তোলা জরুরি। এক দিকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে, সর্বগ্রাসী দুর্নীতির বিরুদ্ধে, উৎকট স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, অন্য দিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে, সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে সোজাসুজি স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে হবে। কথা বলতে হবে সর্বস্তরে, কথা বলতে হবে অবিরত। কথোপকথনের ব্যাপ্তি ও গভীরতা, দুটো ক্ষেত্রেই আমাদের বিরাট ঘাটতি তৈরি হয়েছে— আমরা কেবল নিজেদের মধ্যে কথা বলি, অনেকের সঙ্গে কথা বলি না; আবার আমরা যা বলি সেটাও মুখের কথা, মনের কথা নয়, যে মন সৎ ভাবে এবং যত্ন করে চিন্তা করে সেই মন আমরা হারিয়েছি। কাজটা সহজ নয়, কিন্তু অসাধ্যও নয়। এ-কথা মনে করার কিছুমাত্র কারণ নেই যে, আমাদের লোকসমাজ তার সুচিন্তা এবং সদিচ্ছার সম্ভার হারিয়ে ফেলেছে। হারায়নি যে, এই দুঃসময়েও তার বহু নজির প্রত্যেক দিন তৈরি হয়ে চলেছে, সংবাদপত্রে, সমাজমাধ্যমে, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় আমরা তা দেখছি, পড়ছি, শুনছি। এই সুগভীর, অন্তর্নিহিত শক্তিকে মর্যাদা দিয়েই তৈরি হতে পারে নতুন রাজনীতি। দল এবং উপদলের কুৎসিত রেষারেষি নয়, প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতি। সেই রাজনীতির পতাকার রং কী, সেটা গৌণ প্রশ্ন। স্বেচ্ছাসেবী লাল কি না, সেটা লেনিনের ভক্তবৃন্দ ভাবুন। ভাবা প্র্যাকটিস করুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy