ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গ এখন এক নির্বিকল্প দুর্নীতি-রাজ্য। স্কুলের চাকরি থেকে ত্রাণের ত্রিপল; বালি-পাথর-কয়লা থেকে গরু; নির্মাণ সামগ্রী থেকে হাসপাতালের শয্যা, যে দিকেই চোখ পড়বে, সর্বত্রই দুর্নীতি। এবং, সেই দুর্নীতির সর্বাঙ্গে জড়িত রাজনীতি। এই রাজ্যে দুর্নীতির একটি নির্দিষ্ট ছক এখন অতি স্পষ্ট— সেই ছকটির নাম রেন্ট সিকিং বা খাজনা আদায়। যেখানে যাঁর হাতে যতটুকু ক্ষমতা, তিনি তা ব্যবহার করে কোনও না কোনও অন্যায়কে চলতে দিচ্ছেন— বস্তুত, সেই অন্যায়কে প্রত্যক্ষ সুবিধা করে দিচ্ছেন— এবং বিনিময়ে খাজনা আদায় করে চলেছেন। এই ক্ষেত্রে ‘খাজনা আদায়’টি অন্যায়, কারণ জমি, বাড়ি বা যন্ত্রপাতির মতো ন্যায্য মালিকানায় থাকা সম্পদ নয়, এই ক্ষেত্রে খাজনা আদায় করা হয় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা সামাজিক ক্ষমতা থেকে, যার মালিকানা তাঁদের নয়। তাঁরা নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেনিয়মকে চলার পরিসর তৈরি করে দেন, এবং তার বিনিময়ে সেই বেনিয়ম থেকে উপার্জিত অর্থের বখরা পান। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রক্রিয়াটি এখন সম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে— প্রকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সমান্তরাল একটি কাঠামো। শাসক দলের এমন কোনও নেতার সন্ধান পাওয়া এখন দুষ্কর, যিনি সচেতন ভাবে এই অন্যায়ের বাইরে থাকেন, থাকতে চান। এই প্রবণতার মূল্য চোকাতে হয় রাজ্যের সাধারণ মানুষকে। দুর্নীতির দুর্বিপাকে ঘুরে মরাই বঙ্গবাসী নিজেদের ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন।
প্রশ্ন হল, দুর্নীতি এমন সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে কোন মন্ত্রবলে? গত কয়েক বছরে একটি কথা পশ্চিমবঙ্গে বারে বারেই শোনা গিয়েছে— শাসক দলের হয়ে রাজনীতিই এখন এই রাজ্যে কর্মসংস্থানের সর্ববৃহৎ ক্ষেত্র। এই কথাটির দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমত, শাসক দলের ছাপ নিজের গায়ে লাগাতে পারলেই খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়া সম্ভব। পুলিশ-প্রশাসন ইত্যাদির ঝামেলা নেই— দুর্জনে বলে, খাজনার ভাগ পেলেই তারা তুষ্ট। কথাটির দ্বিতীয় দিক হল, বড় মাপের কর্মসংস্থান হতে পারে, এমন কোনও উৎপাদনশীল ক্ষেত্র এই রাজ্যে নেই। ফলে, রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরা ছাড়া অনেকের কাছেই আর উপায়ান্তর নেই। এই রাজ্য বহু বছর হল গোটা দেশে মেধা সরবরাহ দিয়ে থাকে। বেঙ্গালুরু, দিল্লি-নয়ডা-গুরুগ্রাম, অথবা হায়দরাবাদ, মুম্বই— ভারতের যে কোনও বড় শহরে উচ্চপদে চাকরিরতদের মধ্যে বাঙালির অনুপাত দীর্ঘ দিন ধরেই তাৎপর্যপূর্ণ। ইদানীং অদক্ষ শ্রমিক সরবরাহের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ অগ্রগণ্য। দিল্লির রিকশাচালক, পঞ্জাবের কৃষিশ্রমিক, বেঙ্গালুরুর নির্মাণকর্মীদের মধ্যে বাঙালির অনুপাত বাড়ছে। এই রাজ্যে কাজ নেই বলেই তাঁরা ভিনরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি আসলে বর্তমান প্রশাসনের উন্নয়ননীতির ব্যর্থতার অভিজ্ঞান। যে শিল্পমেধ যজ্ঞের মধ্য দিয়ে বর্তমান শাসকরা রাজ্যের মসনদে বসেছিলেন, তার রেশ থেকে রাজ্যের মুক্তি মেলেনি। বছরে এক বার শিল্প সম্মেলন হয়, প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়, কিন্তু রাজ্য এগোয় না। জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে শাসকদের অবস্থানের ধোঁয়াশা এগারো বছরেও কাটেনি। অন্য দিকে, উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের অভাবে জাঁকিয়ে বসেছে খাজনা আদায়ের প্রবণতা— শিল্পমহলের কাছে এই পরিস্থিতিটিও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। শিল্পের অভাব ঢাকতে সরাসরি মানুষের কাছে সরকারি সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার যে নীতিটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রহণ করেছিলেন, সেটির ব্যর্থতাও স্পষ্ট। চাকরির ব্যবস্থা না করে মাসে পাঁচশো টাকা, বা একটি সাইকেল দিলেই হয় না— বরং, সেই প্রাপ্তিতে অভ্যস্ত হয়ে মানুষ নতুন কিছু চাইতে আরম্ভ করেন। রাজ্যের মুক্তির পথ শিল্পায়ন। এই কথাটি শাসকরা যত দিন না বুঝবেন, বঙ্গের নিস্তার নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy