দখলদারির প্রবণতা বর্তমান ভারতে অনস্বীকার্য সত্য।
কর্নাটকে দু’টি জেলায় দু’টি পৃথক ইদগা-এ গণেশ চতুর্থী আয়োজন করার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। হুবলির ক্ষেত্রে কর্নাটক হাই কোর্ট গণেশ চতুর্থীতে সম্মতি জানিয়ে রায় দিয়েছে; বেঙ্গালুরুর ক্ষেত্রে হাই কোর্ট রাজি না হওয়ায় সুপ্রিম কোর্টে মামলা গিয়েছিল, সেখানেও সম্মতি মেলেনি। শীর্ষ আদালতের তিন সদস্যের বেঞ্চ স্থিতাবস্থা বজায় রাখার রায় দেওয়ার সময় একটি মৌখিক পর্যবেক্ষণ করেছে, যার গুরুত্ব অসীম— আদালত বলেছে, ২০০ বছর ধরে যখন ওই ময়দানে শুধুমাত্র ইদ ও রমজান-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানই হয়েছে, তাকে পাল্টানোর প্রয়োজন নেই। আদালতের এই মন্তব্যটিকে ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবের পরিসরে দেখা বিধেয়। কারণ, এখানে মূল প্রশ্নটি এক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পরিসরটিকে কয়েক দিনের জন্য ছেড়ে দেওয়ার নয়; দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদানেরও নয়— এখানে প্রশ্ন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দখলদারির। এমন নয় যে, বেঙ্গালুরুর চামারাজপেট ইদগা-র ধারেকাছে এমন কোনও পরিসর নেই, যেখানে গণেশ চতুর্থীর আয়োজন করা যায়। কিন্তু, ইদগা-র ময়দানটিতেই গণেশ চতুর্থী করার দাবি উঠেছে, কারণ দাবিটির চালিকাশক্তি স্থানাভাব নয়, দখলদারি। সংখ্যালঘুর জন্য সামাজিক পরিসর ছাড়তে না চাওয়ার মানসিকতা। শীর্ষ আদালত তাতেই বাধা দিয়েছে।
এই দখলদারির প্রবণতা বর্তমান ভারতে অনস্বীকার্য সত্য। বাবরি মসজিদ, জ্ঞানবাপী বা মথুরার ইদগা দখল করতে চাওয়ার পিছনে খাড়া করা হয় ‘ঐতিহাসিক’ যুক্তি। আর, ‘হিন্দুত্বের ইতিহাস’ও যে পরিসরগুলির উপর দাবি জানাতে পারেনি, সেগুলির ক্ষেত্রে সমান অধিকার, অথবা জনপরিসরের যুক্তি নিয়ে আসা হয়। বেঙ্গালুরুর ইদগা-র ক্ষেত্রেও সেই যুক্তিই পেশ করা হয়েছিল। কর্নাটক হাই কোর্ট প্রথমে এই ইদগা-র জমিতে গণেশ চতুর্থীর দাবিটি নাকচ করে দিয়ে অন্তর্বর্তী নির্দেশে জানায় যে, এই মাঠে স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান হবে, ইদ ও বকরি ইদে নমাজ পাঠ হবে, এবং বাকি সময় তা খেলার মাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হবে। কর্নাটকের বিজেপি সরকার অবিলম্বে যুক্তি খাড়া করে যে, কোভিড-১৯’এর চিকিৎসা শিবির হিসাবেও এমন মাঠের ব্যবহার আছে, তাই অন্তর্বর্তী রায়টি প্রত্যাহার করা হোক। পাশাপাশি, অতি দ্রুত গতিতে এই মাঠে গণেশ চতুর্থী পালনের জন্য গণ-আবেদন সংগ্রহের কাজও চলে। দু’দিন পরে কর্নাটক হাই কোর্টের একটি ভিন্ন বেঞ্চ আগের নির্দেশটি পরিবর্তন করে। শেষ অবধি মামলা সুপ্রিম কোর্টে যায়। এবং, গোটা ঘটনাটি ঘটে মাত্র ছ’দিনের মধ্যে।
অর্থাৎ, এই দ্বন্দ্বটি আর দুই সম্প্রদায়েরও নয়, এর মধ্যে বিজেপি সরকার প্রকট ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থে লড়ছে। এইখানেই সংবিধান থেকে বিচ্যুতি ঘটে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান রাষ্ট্রকে সব ধর্মের প্রতি সমদর্শী, নিরপেক্ষ হতে বলে— ধর্মীয় বিতর্কে রাষ্ট্র কোনও প্রত্যক্ষ পক্ষ হতে পারে না। কিন্তু, আজকের ক্রমশ গৈরিক-ভাবাপন্ন ভারতে এই সমদর্শিতা অকল্পনীয়। রাষ্ট্র যদি প্রকৃত অর্থেই নিরপেক্ষ হত, তবে সম্ভবত মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষেও উদারতর অবস্থান গ্রহণ করা সম্ভব হত— ইদগা-র জমি ছেড়ে দেওয়া যেত হিন্দুধর্মের অনুষ্ঠানের জন্য। কিন্তু, বাস্তব হল, এখানে ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে নয়, জমি ছাড়লে তা ছাড়তে হয় রাষ্ট্রশক্তির মদতেপুষ্ট হিন্দু জাতীয়তাবাদকে, যার লক্ষ্য হল দখলদারি। ইতিমধ্যেই অযোধ্যা থেকে বহু ক্ষেত্রে সেই দখলের কাজ অনেক এগিয়েছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, গ্রহণশীল সংস্কৃতির আত্মাকে রক্ষা করতে হলে এই দখলদারির প্রবণতায় বাঁধ দেওয়া জরুরি। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণটি এখানেই তাৎপর্যপূর্ণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy