Advertisement
৩০ জুন ২০২৪

দ্বিতীয় সুযোগ

জীবনে প্রথম বার শরিক-নির্ভর সরকার গড়তে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী সত্য সত্যই ‘সব কা সাথ’ চলতে উদ্যোগী হবেন, এমন ভাবনার অবকাশ তৈরি হয়েছিল।

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪ ০৭:৪৬
Share: Save:

সাত দশকের ইতিহাসে চতুর্থ বার লোকসভার স্পিকার পদের জন্য ভোটে যেতে হল, গত প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবৎ ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্পিকার নির্বাচনের নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্যে ছেদ পড়ল— এই নিয়ে আক্ষেপ বা দীর্ঘশ্বাস আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিহীন। বহু দল, বহু মত, বহু স্বার্থের টানাপড়েনে চালিত গণতন্ত্রকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপায় হিসাবে বহু ক্ষেত্রেই নির্বাচন কার্যত অপরিহার্য একটি প্রকরণ। লোকসভার পরিচালনা যিনি করবেন, সভাসদরা নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁকে বেছে নিলে সংবিধান বা মহাভারত কোনওটিই অশুদ্ধ হয় না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যদি এ ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, ভাল, কিন্তু তার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, থাকা কাম্যও নয়। বরং ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার ঐকমত্য চাই’ গোছের রীতি অনুসরণ করতে গিয়ে পর্দার আড়ালে রকমারি প্যাঁচ-পয়জার কষতে হলে গণতন্ত্রের মানরক্ষা হয় না। মতানৈক্য থাকলে সরাসরি তার মোকাবিলা এবং মীমাংসা করাই শ্রেয়।

যে প্রেক্ষাপটে এবং পরিপ্রেক্ষিতে অষ্টাদশ লোকসভার স্পিকার নির্বাচন হল, সমস্যা সেখানেই। গত দশ বছরে শাসক শিবিরের যে অনমনীয় ও অসহিষ্ণু আধিপত্যবাদ এ দেশের গণতন্ত্রকে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে, নতুন লোকসভায় সেই ধারা থেকে অন্তত কিছুটা পরিবর্তন ঘটতে পারে, এমন প্রত্যাশা অনেকের মনেই ছিল। জীবনে প্রথম বার শরিক-নির্ভর সরকার গড়তে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী সত্য সত্যই ‘সব কা সাথ’ চলতে উদ্যোগী হবেন, এমন ভাবনার অবকাশ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সংসদ ভবনে প্রবেশের পরে সংবিধান মাথায় ঠেকানোর দৃশ্য রচনা এবং প্রাথমিক বক্তৃতায় ‘গঠবন্ধন’ সম্পর্কে বড় বড় কথার ফুলঝুরি ছোটানোর পালা সাঙ্গ করেই তিনি প্রবল প্রতাপে ‘ধারাবাহিকতা’ প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়ে ওঠেন। প্রোটেম স্পিকার পদে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙে নিজের পছন্দের লোক বসানো বা ডেপুটি স্পিকার পদের জন্য বিরোধী শিবিরের দাবিতে কর্ণপাত না-করার সিদ্ধান্ত সেই পরিচিত প্রতাপ-অন্ধতার সুস্পষ্ট প্রমাণ। এই পরিস্থিতিতে, বিশেষত বিগত লোকসভায় শ্রীযুক্ত ওম বিড়লার ‘কঠোর’ আচরণ এবং নানা ‘ঐতিহাসিক’ সিদ্ধান্তের কথা মনে রাখার পরে, বিরোধীদের পক্ষে শাসক শিবিরের পুনর্মনোনীত স্পিকারকে একবাক্যে মেনে নেওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। নতুন সংসদের প্রত্যুষেই এই স্পিকার-পর্ব নতুন করে জানিয়ে দিল যে, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সতীর্থরা ঐকমত্যের একটিই অর্থ বোঝেন: তাঁদের কথা সবাইকে মেনে নিতে হবে। নির্মম সত্য এই যে, তাঁদের আধিপত্যবাদী মানসিকতা অপরকে মর্যাদা দিতে জানে না, কেবল তাকে গ্রাস করতে চায়।

এই সত্যটি মনে মনে জানেন বলেই কি প্রধানমন্ত্রীকে এই ২০২৪ সালে লোকসভায় শপথ গ্রহণ করতে এসে সত্তরের দশকের জরুরি অবস্থার পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে প্রধান বিরোধী দলের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে হল? জরুরি অবস্থা ঐতিহাসিক সত্য এবং ইতিহাসের কলঙ্ক। কিন্তু সেই ইতিহাস বহু-আলোচিত; এবং সেই আলোচনায় নতুন কোনও আলো ফেলার সাধ্য যে বর্তমান শাসকদের নেই, সে-কথা এই বিষয়ে তাঁদের বস্তাপচা কথামালার পুনরাবৃত্তিই বারংবার বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীও সেই ফাটা রেকর্ডই আরও এক বার চালিয়েছেন। এই আচরণ কি রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার প্রমাণ? না গত দশ বছরে যে অঘোষিত জরুরি অবস্থার দাপট চলছে, তার থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই এই অসার এবং অবান্তর অতীতমন্থন? মন্ত্রিসভার শিখরে একই মুখের সারি ফিরে এসেছে, এখন স্পিকারের আসনেও পুরনো মূর্তির পুনরাগমন ঘটল। দেশ ও দুনিয়া আশা করবে, মূর্তি এক থাকলেও মানসিকতায় এবং আচরণে উত্তরণ ঘটবে, পুনরাগত স্পিকার সংসদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হবেন, শাসক শিবিরের স্বার্থের উপরে স্থান দেবেন গণতন্ত্রের মর্যাদাকে। ইতিহাস তাঁকে কী ভাবে মনে রাখবে, তা স্থির করার দ্বিতীয় সুযোগ তিনি পেয়েছেন। সুযোগমাত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE