ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়।
অভিযুক্তকে জামিন দেওয়াই নিয়ম, বিশেষ কারণ ছাড়া তাঁকে জেলবন্দি করা অনুচিত, মনে করালেন ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। এ কথার গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতে জেলবন্দিদের অধিকাংশই বিচারাধীন বন্দি। তদুপরি, সামান্য কারণে বা অকারণে বিরোধী ও সমালোচকদের গ্রেফতার করে দীর্ঘ দিন জেলবন্দি করার প্রবণতা বিভিন্ন রাজ্যের সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার, দু’তরফেই দেখা যাচ্ছে। যথাযথ কারণ ছাড়াই নানা কঠোর ধারা আরোপ করা হচ্ছে সমাজকর্মী, সাংবাদিক, গবেষক এবং বিরোধী নেতা-কর্মীদের উপরে, যাতে জামিন পাওয়া কঠিন হয়। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ নয়, সরকারের সমালোচকদের হয়রানি, ভীতিপ্রদর্শনই গ্রেফতার করার মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠছে, এমন অভিযোগ বার বার উঠেছে। সম্প্রতি বেঙ্গালুরুতে একটি বক্তৃতার পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে গ্রেফতারে স্বেচ্ছাচারের প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি জামিন দেওয়ার বিধি যথাযথ ভাবে পালনের গুরুত্ব ফের মনে করান। তিনি বলেন, অনেক সময়ে নিম্ন আদালতগুলি সমালোচনা এড়ানোর জন্য জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়। এর ফলে নিম্ন আদালতে যে অভিযুক্তদের জামিন পাওয়া উচিত, তাঁরা যাচ্ছেন হাই কোর্টে, সেখানেও না পেলে সুপ্রিম কোর্টে। সরকারি স্বেচ্ছাচারে যাঁরা গ্রেফতার হচ্ছেন, তাঁদের পরিস্থিতি আরও কঠিন হচ্ছে জামিনে বিলম্ব ও জটিলতার কারণে। এ কথা অতীতেও বার বার মনে করিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। এ বছরই এপ্রিল মাসে গুজরাতে জেলা আদালতের বিচারকদের একটি সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারকে গুরুত্ব না দেওয়ার যে প্রবণতা নিম্ন আদালতগুলিতে দেখা যায়, তা বদলাতে হবে। সম্প্রতি ফের বললেন, মুক্তিকামী মানুষদের প্রয়োজন যাতে নিম্ন আদালতের বিচারকরা মনে রাখেন, সে জন্য তাঁদের উৎসাহ দিতে হবে। তাঁরা যেন জামিনের আবেদন বিবেচনার সময়ে নিজেদের সাধারণ বুদ্ধির (কমন সেন্স) শক্তিকে কাজে লাগান।
এই কথাটি অনুধাবনের যোগ্য। জামিন আবেদনের বিপক্ষে পুলিশের যুক্তিগুলিকে যথেষ্ট খুঁটিয়ে না দেখেই বিচারকরা জামিন প্রত্যাখ্যান করছেন, এই ধারণার সপক্ষে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে। অকারণে জামিন বাতিলের ঘটনা কেবল রাজনৈতিক কারণে বন্দিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ২০২২-এর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী ৫,৫৪,০৩৪ বন্দির মধ্যে ৪,২৭,১৬৫ (৭৬%) বিচারাধীন বন্দি। এঁদের একটি বড় অংশ গরিব ও দুঃস্থ মানুষ। এঁরা জামিন পেলে অপরাধের প্রমাণ লোপ করে দেবেন, সাক্ষীদের উপর চাপ সৃষ্টি করবেন, তার সম্ভাবনা কতটুকু? দীর্ঘ দিন জেলবন্দি থাকার পর নিরপরাধ প্রমাণিত হয়ে ছাড়া পেয়েছেন, এমন ব্যক্তিও কম নন। জামিনের আবেদন খারিজ করা তাঁদের জীবনে অকারণ শাস্তি হয়ে এসেছে, যা সারা দেশের লজ্জা। তাই নিম্ন আদালতের উপর আস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার— এই পরামর্শ দ্বিমুখী। আদালতকে আস্থা অর্জন করতে হবে, সমাজকেও আস্থা রাখতে হবে।
তার জন্য প্রয়োজন জামিন বিষয়ে সাধারণ ধারণার পরিবর্তন, মনে করিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। জামিনের আবেদন মঞ্জুর করার সিদ্ধান্তকে সন্দেহের চোখে দেখার প্রবণতার কারণ কী? সংবাদমাধ্যম, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সামাজিক সংগঠনগুলির দায় এ বিষয়ে কম নয়। অভিযুক্তকে জেলবন্দি রাখাই সুবিচার, জামিনে মুক্তি মানে পুলিশ-প্রশাসনে দুর্নীতি বা বিচারের শিথিলতা— এই ভ্রান্ত ধারণা ছড়ানোয় তাঁদেরও ভূমিকা রয়েছে। মুক্ত থাকা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বিশেষ কয়েকটি কারণ ছাড়া রাষ্ট্র সেই অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে না। অথচ, সমাজে এখনও এমন ধারণা রয়েছে যে, হাজতবাস বা কারাবাস অভিযুক্তের ‘উচিত শাস্তি’। অভিযুক্ত দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে বন্দি করা অনুচিত— এই ধারণা সমাজ গ্রহণ করছে না বলেই সরকারের পক্ষে নিরপরাধ নাগরিককেও দীর্ঘ দিন জেলবন্দি করা সহজ হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy