Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Narenra Modi

ভক্তিরোগ

ভক্তিতে অসুবিধা নাই, সমস্যা ভক্তির দেখনদারিতে। নেতার প্রতি নিষ্প্রশ্ন আনুগত্যে এই ভারত নাগরিককে আত্মাহুতি পর্যন্ত দিতে দেখিয়াছে।

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:০৬
Share: Save:

গণিতে অঙ্ক কষিতে হইত, তৈলাক্ত বংশদণ্ডের শীর্ষ ছুঁইতে বানর উঠিতেছে, সরসর করিয়া নামিয়া যাইতেছে, ফের উঠিতেছে। রাজনীতির অঙ্কেও একই তুলনা মিলিবে, শীর্ষনেতার মন পাইতে অধস্তন নেতা-মন্ত্রী-কর্মী-সমর্থকের নিরন্তর স্তুতি। তফাত একটাই: এই স্তাবকতায় কোনও অবরোহণ নাই, শুধুই আরোহণ, অবশ্য যদি না দলই বদলাইয়া যায়। একদা অবিসংবাদিত নেত্রীর প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে এক বড় রাজনীতিক বলিয়াছিলেন, আমার নেত্রী যদি ঝাড়ু হাতে লইয়া ঝাড়ুদারের কাজও করিতে বলেন, আমি করিব। তাহা অবশ্য করিতে হয় নাই, তবে সেই রাজনীতিক পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি হইয়াছিলেন। কে কী পাইবেন বা হইবেন তাহা পরের কথা, আসল কথাটি হইল: ভারতের রাজনীতি, ক্ষমতা ও সরকার পরিচালনা, সমস্ত কিছুতেই অনুগামীদের নিষ্প্রশ্ন আনুগত্য, অন্ধ ভক্তি ও চরম স্তাবকতার ধারাটি চিরবহমান।

এবং তাহা দলনির্বিশেষে। দলনেতৃর তোষামোদে বড় বা ছোট দলে, কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে শাসক বা বিরোধী দলেও প্রভেদ নাই। এই প্রবণতা ভূগোলনিরপেক্ষও, উত্তর-দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিম ভারতে তফাত নাই, দলপ্রধানের তুষ্টিতেই অধস্তনদের যাবতীয় মনোযোগ ও ক্রিয়া সমর্পিত। দক্ষিণ ভারতে শীর্ষনেতৃভজনা তো চলচ্চিত্রসুলভ দেখনদারি, ব্যক্তিপূজা ও কর্তৃত্ববাদের মিশ্রণে অন্য এক স্তরে উন্নীত। ইহা এক সর্বভারতীয় উপসর্গ— রোগলক্ষণও বলা যাইতে পারে। বিপুল জনসমর্থনই হয়তো নেতাকে দল বা সরকারের শীর্ষে বসাইয়া দিয়াছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই— কিন্তু দেখা যায়, ক্ষমতাসীন হইবার পরেই স্তাবক ও পারিষদের দল তাঁহাকে ঈশ্বরের ন্যায় তর্কাতীত ও প্রশ্নাতীত করিয়া তোলে। নেতাও তখন আত্মগরিমায় ভুগিতে থাকেন, জনমতকে করিয়া লন আধিপত্য খাটাইবার অস্ত্র। তখন সুপ্রশাসন ও জনসেবা আর লক্ষ্য থাকে না, উন্নয়ন ও প্রগতির প্রতিশ্রুতি মুছিয়া যায়, তাহার জায়গা লয় নির্লজ্জ আত্মপ্রচার। জোড়হস্ত মোসাহেবরা তাহা শতগুণ ফাঁপাইয়া তুলে; নেতা যাহা পরেন, যাহা খান, যাহা বলেন, যাহা করেন, শুধু তাহাই যেন দেখিবার, উহাতেই দেশের কল্যাণ।

এই পদলেহী সংস্কৃতি সুপ্রশাসনের পরিপন্থী। শাসকের ছায়া নাগরিককে ছাপাইয়া প্রলম্বিত হইলে, শাসক নিজে তাহা উপভোগ ও সমর্থন করিলে দেশের ও দশের এই মুহূর্তের ও সুদূরপ্রসারী প্রয়োজনগুলি হইতে মুখ ঘুরাইয়া থাকা হয়। তখন অতিমারি মোকাবিলা বা টিকাকরণে গতি, বেহাল অর্থনীতি বা কৃষক সমস্যা পিছু হটে, প্রচারের আলো জুড়িয়া থাকে কেবল নেতার সযত্নচর্চিত কায়া ও ভাবমূর্তি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে তাঁহার প্রচার ও প্রশংসাসর্বস্ব বিজ্ঞাপন প্রচারমাধ্যমে উপচাইয়া পড়িল, উত্তরপ্রদেশ-অসম-মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা ভক্তিগদগদ হইলেন, আক্ষরিক অর্থেই প্রশস্তিগীত গাহিয়া সমাজমাধ্যমে পোস্ট করিলেন কেহ। ভক্তিতে অসুবিধা নাই, সমস্যা ভক্তির দেখনদারিতে। নেতার প্রতি নিষ্প্রশ্ন আনুগত্যে এই ভারত নাগরিককে আত্মাহুতি পর্যন্ত দিতে দেখিয়াছে। কিন্তু তাহা হইতে দেওয়া কি প্রশাসকের কাজ? চিৎকৃত ভক্তি দেখিলে সংশয় জাগে, উহা ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে নাগরিক বিচারবোধের বলিদান ছাড়া অন্য কিছু নহে। আর দেবতা হইতে চাওয়া যে নেতারা সানন্দে সেই বলি চাহেন, গ্রহণও করেন, তাঁহাদের বিষয়ে আর অধিক কী বলিবার।

অন্য বিষয়গুলি:

Narenra Modi Pranab Mukjherjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy