Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
West bengal Assembly

লজ্জা ও তার বোধ

পরিষদীয় মন্ত্রী এবং প্রবীণ বিধায়কদের কেউ কেউ তাঁর সমালোচনায় কণ্ঠ মিলিয়েছেন, ফাঁকির অবসান ঘটানোর জন্য সচেষ্ট হওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা।

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৫০
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদ্য-সমাপ্ত অধিবেশনের শেষে প্রথা অনুসারে বিধায়কদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে উঠেছিলেন সভার স্পিকার বা অধ্যক্ষ। কিন্তু প্রথামতো ‘তুমি ধন্য ধন্য হে’ বাণীতে তিনি নিজেকে সীমিত রাখেননি। একটি আক্ষেপ তথা ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। ক্ষোভ বিধায়কদের আচরণ নিয়ে। বিধানসভার স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলির বৈঠকে সদস্যদের অনেকেই আপন ভূমিকা পালন করেন না, হাজিরা খাতায় সই করে দায় সারেন— এই প্রবণতা নিয়ে অভিযোগ করেছেন মাননীয় অধ্যক্ষ। তাঁর আরও অভিযোগ, কমিটির সদস্য হিসাবে সরকারি কাজ পরিদর্শনের দায়িত্বও তাঁরা অনেক সময়েই পালন করেন না। কর্তব্যে অবহেলার জন্য অধ্যক্ষ তাঁদের সতর্ক করে দিয়েছেন। পরিষদীয় মন্ত্রী এবং প্রবীণ বিধায়কদের কেউ কেউ তাঁর সমালোচনায় কণ্ঠ মিলিয়েছেন, ফাঁকির অবসান ঘটানোর জন্য সচেষ্ট হওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন। পরবর্তী অধিবেশনে এই আশ্বাস তাঁদের মনে থাকবে কি না বলা কঠিন, পলায়নপর জনপ্রতিনিধিদের কর্মনিষ্ঠা উৎপাদন আরও অনেক বেশি কঠিন। কিন্তু অন্তত অপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনাটি স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণের জন্য অধ্যক্ষ মহাশয়কে রাজ্যের নাগরিকরা অভিবাদন জানাবেন। সন্দেহ নেই যে, প্রকৃত ধন্যবাদ তাঁরই প্রাপ্য।

যে বিধায়করা নির্ধারিত কর্তব্য পালন করেন না, তাঁদের আচরণ লজ্জাকর এবং অন্যায়। তার একটা কারণ, এই কর্তব্য সম্পাদনের জন্য তাঁরা ভাতা পান, যে ভাতার সংস্থান হয় জনসাধারণের প্রদত্ত রাজস্ব থেকে। বস্তুত, কমিটির বৈঠকের হিসাব রাখার জন্য নির্ধারিত নথিতে স্বাক্ষর না করলে ভাতা মেলে না, সুতরাং এ-কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ওই প্রাপ্য অর্থ যাতে পাওয়া যায় সেই কারণেই সদস্যরা খাতায় স্বাক্ষরটি করেন। এই অনুমান যদি সত্য হয় তবে লজ্জা এবং অন্যায় দুইয়েরই ভার পর্বতপ্রমাণ। কিন্তু প্রশ্ন কেবল টাকা নিয়ে কাজ না-করার নয়। স্ট্যান্ডিং কমিটির কাজ সদস্য-বিধায়কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আইনসভায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও পর্যবেক্ষণের যে কাজ এই সব কমিটিকে দেওয়া হয়, সেগুলি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের মৌলিক অঙ্গ। আইনসভায় বিশদ এবং গভীর আলোচনা সম্ভব হয় না বলেই বহু বিষয়ে সদস্যদের নিয়ে কমিটি গড়ার রীতি প্রচলিত হয়েছে। আইন-প্রস্তাব ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকৃত বিচার-বিশ্লেষণ কমিটিতেই হওয়ার কথা। এ-কালে বিধানসভায় বা লোকসভায় কোনও কাজই ঠিকমতো হয় না, তাই কমিটি স্তরের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। সেখানেও যদি সদস্যরা ‘সই করি ভাতা পাই’ নীতি অনুসরণ করেন, তা হলে আপন গণতান্ত্রিক ভূমিকা তথা পদটির বিপুল অসম্মানের কারণ হয়ে ওঠেন না কি? জনপ্রতিনিধি বা বিধায়ক শব্দগুলিই কি তখন তাঁদের লজ্জা দেয় না?

হয়তো দেয় না। লজ্জার কারণ ঘটলেই যে লজ্জা পেতে হবে এমন তো নয়, লজ্জাবোধ থাকাও জরুরি বইকি। পরম দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, জনপ্রতিনিধিদের সকলেরই সেই বোধ আছে কি না অথবা অবশিষ্ট আছে কি না তা নিয়ে নাগরিককে এখন সংশয়ে ভুগতে হয়, প্রায়শই গভীর সংশয়ে। বিশেষত, রাজনীতিকদের একটি বিরাট অংশের কাছে আইনসভার প্রকৃত গুরুত্ব ও মর্যাদারস ক্ষয় হতে হতে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, অতীতের জনপ্রতিনিধিরা তা বোধ করি কল্পনাও করতে পারতেন না। অবশ্য, ভয়াবহ কল্পনার গণ্ডি অতিক্রম করাই বর্তমান রাজনীতির ধর্ম। গণতান্ত্রিক কর্তব্য সম্পাদনের পরিসর থেকে সংসদ ও বিধানসভা আজ বহুলাংশে পর্যবসিত হয়েছে ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির উৎস ও প্রকরণে। এখনও ব্যতিক্রমেরা সর্বত্রই আছেন, তাঁরা সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়ে যাননি। কিন্তু বড় ছবিটা লজ্জার, দুর্ভাগ্যের, অন্যায়ের। অধ্যক্ষের তিরস্কারে সেই ছবির একটি অংশ উন্মোচিত হয়েছে। অংশমাত্র।

অন্য বিষয়গুলি:

West bengal Assembly Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy