Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Salman Rushdie

অমানবিক

সলমন রুশদির উপর আক্রমণের ভয়াবহতাকেও যেন ছাপিয়ে যায় এই অবিশ্বাস্য মানসজগৎ।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২২ ০৭:২৫
Share: Save:

মধ্যরাতের সন্তান আক্রান্ত। বিশ্বখ্যাত লেখক সলমন রুশদির উপর অতর্কিতে নৃশংস আঘাত নেমে এল ১৫ অগস্ট মধ্যরাতের তিন দিন আগেই, নিউ ইয়র্কের এক সভাস্থলে। কুড়ি সেকেন্ড ধরে তাঁর উপর ছোরার কোপ। আজ পাঁচ দিন পরও তাঁর আরোগ্য সংশয়াতীত নয়, শোনা যাচ্ছে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর শরীরযন্ত্র হয়তো আর স্বাভাবিক হবে না, তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে, হয়তো কথাও আর বলতে পারবেন না। এই ঘটনার ‘দৌলতে’ বিশ্ব-ইতিহাসে যোগ হল মানবতার আর এক ভয়ঙ্কর পরাজয়, যেখানে স্বাধীনচেতা সাহসী সত্যসন্ধানী সাহিত্যিককে তাঁর সাহিত্যরচনার মূল্য চোকাতে প্রস্তুত থাকতে হয় নিজের প্রাণের বিনিময়ে। ঘৃণ্য আততায়ী যে ইসলাম ধর্ম বিষয়ে রুশদির ভাবনা ও বক্তব্যের কারণেই এই আঘাত হেনেছে, সন্দেহের অবকাশ নেই। সন্দেহ নেই যে, এই কাজকে এক জন ব্যক্তির আকস্মিক পাগলামি কিংবা মনোবিকার বলে পাশে সরিয়ে রাখা যাবে না। মনে রাখতে হবে, গত তিন দশক ধরে রুশদি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই বাঁচতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁকে সর্বদা ঘিরে থেকেছে রক্ষীচক্ষুজাল। সেটানিক ভার্সেস প্রকাশের পর ইরানের ধর্মগুরু আয়াতোল্লা খোমেনির ফতোয়া জারির পর থেকেই এই ত্রাস তাঁকে এবং তাঁর শুভানুধ্যায়ী সমাজকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সুতরাং, তেত্রিশ বছর পরের এই আততায়ীকে কোনও ব্যক্তি না বলে, এক সম্মিলিত শক্তির মুখপাত্রই বলা যেতে পারে। কী সেই সম্মিলিত শক্তি? তার নাম— উগ্র সহিংস ইসলাম, বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে যা ছড়িয়ে আছে, কোনও ব্যক্তিপরিসরে বা কোনও মুক্তচিন্তায় যা বিশ্বাস করে না, তার নিজের কট্টর, অসংবেদনশীল বিশ্ববীক্ষা থেকে কোনও রকম বিচ্যুতি দেখলেই তাকে শাস্তি দিতে চায় তীব্র শারীরিক অত্যাচার ও নিধনের মাধ্যমে। আশ্চর্য নয় যে, এমন ঘটনার পরও ভ্রুক্ষেপ-ব্যতিরেকে ইসলামি বিশ্বের সেই কট্টর অংশের প্রতিনিধিস্বরূপ ইরানের সরকারি প্রচারমাধ্যমের কর্তা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, ‘শয়তানকে অন্ধ করে দেওয়া গিয়েছে’।

ঘটনার থেকেও কখনও কখনও ঘটনার অভিঘাত বড় হয়ে ওঠে। সলমন রুশদির উপর আক্রমণের ভয়াবহতাকেও যেন ছাপিয়ে যায় এই অবিশ্বাস্য মানসজগৎ। বর্ষীয়ান মানুষকে ছোরার কোপে হত্যার চেষ্টা দেখে এমন প্রকাশ্য উৎফুল্লতা দেখাতে পারেন যাঁরা, তাঁদের পক্ষে কি কোনও ধর্মবোধের গৌরব করা সাজে? যা-ই লিখে থাকুন না কেন রুশদি, তাঁর লেখা পছন্দ না হলে তাঁকে ও সেই লেখাকে উপেক্ষা করা কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু তার বদলে ফতোয়া জারি করার অর্থ একটিই: শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে হিংসা সত্য, তাহার উপরে নাই! অর্থাৎ, স্বাধীন চিন্তার অধিকার গ্রাহ্য নয়— এই কথাই ফতোয়া-শিবির বলতে চায়। স্বাভাবিক ভাবেই, রুশদিও হয়ে ওঠেন বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারের প্রতীক, ধারক ও বাহক। এই আঘাতের যন্ত্রণা তাই তিনি একাই বহন করছেন না, তাঁর সঙ্গে করছেন সমগ্র বিশ্বের সকল স্বাধীনচেতা অধিকারকামী মানুষ।

এই আক্রমণকে ঘিরে প্রকট ও প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে রাজনীতি ও কূটনীতির ঊর্ণনাভজালিকা। এ-হেন ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদের আগেও জরুরি হয়ে উঠছে ক্ষমতার ছক, চাওয়া-পাওয়ার হিসাবনিকাশ। ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী-পদপ্রার্থী ঋষি সুনক যখন সোজাসুজি ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চান, ভারত সরকার কিন্তু নির্বাক নিশ্চুপ। কূটনৈতিক স্বার্থের চাপ বুঝতে অসুবিধা হয় না, কিন্তু তাই বলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যরত্নের জীবনকে বাজি রেখেও? দেশাভ্যন্তরে মুসলিম সমাজের নির্বিবাদী সাধারণ্যের উপর অকারণে খড়্গহস্ত হওয়া চলে, কিন্তু দেশের বাইরে হিংস্র ইসলামি উগ্রবাদ দেখেও মুখে কুলুপ? একটিই শব্দ প্রযোজ্য এই প্রসঙ্গে: অমানবিক।

অন্য বিষয়গুলি:

Salman Rushdie Author
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy