এই ‘অফার লেটার’ নিয়ে বিতর্ক।
চাকরির প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবের মধ্যে বিরাট দূরত্ব থাকবে, সেটা এ-দেশের মানুষ এখন স্বাভাবিক এবং কার্যত অনিবার্য বলেই ধরে নিয়েছেন। রাজনীতিকরাও পরোক্ষে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, এ-সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সম্ভব নয়, এখন তাঁরা অম্লানবদনে বেকারদের পকোড়া বেচে ‘স্বনিযুক্ত’ হওয়ার পরামর্শ দেন, কিংবা পুজোর বাজারে ঝালমুড়ি এবং ঘুগনি বিক্রি করতে বলেন। ভুক্তভোগী নাগরিকরা ক্রমে ক্রমে এই ‘জুমলা’য় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক কাণ্ডকারখানা এই ধারায় এক অভূতপূর্ব সংযোজন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর পৌরোহিত্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে কর্মপ্রার্থীদের চাকরিতে নিয়োগপত্র দেওয়ার কথা ঘোষিত হল, এমনকি সংশ্লিষ্ট ‘নথিপত্র’ও মঞ্চে আনা হল, মুখ্যমন্ত্রী সে-সব ‘খতিয়ে’ দেখে কে কোথায় চাকরি পেয়েছেন, মায় কে কত মাইনে পাবেন সেই খবরও কিছু কিছু তাঁর পরিচিত ভঙ্গিতে প্রচার করলেন, কিন্তু এই নাটকীয় ঘোষণার মধ্যেই টের পাওয়া গেল যে, বিভ্রান্তির শেষ নেই— কারা সত্যই নিয়োগপত্র পেয়েছেন বা পেতে চলেছেন, তার কোনও পরিষ্কার ধারণাই মিলল না। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই আধিকারিকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানালেন, তিনি ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছেন।
এহ বাহ্য। নাটকের পরবর্তী অঙ্কে ফাঁস হল যে, অন্তত কিছু চিঠি নাকি আসলে নিয়োগপত্রই নয়, চাকরির প্রাথমিক প্রস্তাবমাত্র। এখানেই কুনাট্যের শেষ নয়। অতঃপর গুজরাতের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে খবর মিলেছে যে, সেই প্রস্তাবপত্রও ভুয়ো, তারা এ-রাজ্যে ও-রকম কোনও প্রস্তাবপত্র পাঠায়নি! গোটা ব্যাপারটাই এখন রহস্যের অতলে, যাঁরা ‘চাকরি’ পেয়েছিলেন বা পাওয়ার ভরসা করছিলেন তাঁদের অন্তত একটি অংশ অথৈ অনিশ্চয়তায়। চাকরি না থাকার যন্ত্রণা ভয়ানক, কিন্তু চাকরির আশায় উজ্জীবিত হয়ে আশাভঙ্গের বেদনা যে কী ভয়ানক, ক্ষমতাবানেরা তা জানেন কি? আদৌ এ নিয়ে ভাববার কোনও বাসনা কি তাঁদের অন্তরে স্থান পায়? হাজার হাজার চাকরি দেওয়ার সাড়ম্বর প্রচার থেকে জনপ্রিয়তার রাজনীতির ফসল তুলে নেওয়াই কি আপাতত তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য?
‘ভুয়ো নিয়োগপত্র’ সংক্রান্ত অভিযোগের নিরসন কী ভাবে হবে, প্রকৃত সত্য কবে উদ্ঘাটিত হবে বা আদৌ হবে কি না, সে বিষয়ে গভীর সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু প্রবঞ্চনার অভিযোগ সরিয়ে রাখলেও একটি বড় প্রশ্ন থেকে যায়। কর্মপ্রার্থীরা যদি কোনও সংস্থায় চাকরি পান, তার নিয়োগপত্র সরকারি মন্ত্রী বা আধিকারিকরা সভামঞ্চে তাঁদের ডেকে বিলি করবেন কেন? এ কি অকারণে সম্পূর্ণ অনধিকার চর্চা নয়? এ ক্ষেত্রে সম্পর্ক বা সংযোগ কেবল যিনি নির্বাচিত কর্মী এবং যাঁরা তাঁকে নিয়োগ করছেন, তাঁদের মধ্যে। সরকারি সংস্থার ক্ষেত্রে যদি কোনও বিশেষ অনুমোদন বা ছাড়পত্রের প্রয়োজন থাকে, তারও নিজস্ব পদ্ধতি আছে, প্রক্রিয়া আছে, যে প্রক্রিয়া মঞ্চে দাঁড়িয়ে পারিতোষিক বিতরণের শৈলীতে সম্পাদন করার কিছুমাত্র সুযুক্তি নেই। অতএব অনুমান করতে হয়, কুযুক্তিই এই রহস্যের একমাত্র সমাধানসূত্র। কে কোথায় কাকে চাকরি দিচ্ছেন, কাজের বাজারের সেই স্বাভাবিক ও গতানুগতিক প্রক্রিয়াটিকে ভাঙিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়োনোর কুযুক্তি। দুর্নীতি এবং অপদার্থতার কারণে যদি এই উদ্যোগের ফল বিপরীত হয়, মুখ্যমন্ত্রী হয়তো পচা শামুকে পা কাটবার জন্য নিজেকে সঙ্গোপনে দোষী করবেন। কিন্তু ঘটনা এই যে, পচা শামুকটি তাঁর স্বাভাবিক চলার পথে ছিল না, কিংবা পথে পড়ে থাকলেও তাকে এড়িয়ে চলাই যেত— তিনিই গায়ে পড়ে এই বিপাক সৃষ্টি করেছেন। নিয়োগপত্র ভুয়ো না হলেও রাজ্য সরকারের চালকদের এই অনধিকার চর্চার উদ্যোগ অনৈতিক, লজ্জাকর এবং কুরুচিপূর্ণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy