অপরাজেয়: এবিভিপি’র উপদ্রবের প্রতিবাদে পুলিশের সদর দফতরের সামনে ছাত্রছাত্রীরা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই
গ ত একুশে ফেব্রুয়ারি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রামযশ কলেজে একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয়। বিষয় ছিল ‘প্রতিবাদের সংস্কৃতি’। বক্তারা তাঁদের মতো করে এই বিষয়ে নিজেদের বক্তব্য সাজিয়েছিলেন, এবং অনেক ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক সেই আলোচনা শুনতে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটির আয়োজকরা জেএনইউ-এর পড়ুয়া উমর খালিদ এবং শেহলা রাশিদকেও আমন্ত্রণ জানান বক্তা হিসেবে। আর তার পরেই শুরু গোলমালের। এবিভিপি আপত্তি জানায় এবং বলে যে উমর ও শেহলাদের মতো ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’দের তারা কোনও মতেই বলতে দিতে চায় না। তর্কাতর্কি, গাজোয়ারি এবং ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে এবিভিপি-র কর্মীরা উদ্যোক্তাদের বাধ্য করে আলোচনাসভা বাতিল করতে। পরের দিন ভারতমাতার সম্মান বাঁচাতে সঙ্ঘের ছাত্র সংগঠনটি রাস্তায় রাস্তায় মারামারি করে, মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি দেয়, আর তাদের নাপসন্দ আরও অনেক সেমিনার বা আলোচনা বাতিল করার ফিকির খোঁজে। এবিভিপি দিল্লিতে মারামারি আর ধমকচমককেই নিজেদের রাজনীতি করে তুলেছে।
গত এক বছরে এই ছবিটি খুবই চেনা। কোনও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনাসভার আয়োজন হয়েছে; এবিভিপি-র তাতে সায় নেই, কারণ তাদের মনে হয়েছে আলোচনার বিষয়, আয়োজক ও বক্তা, সবই ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’; আর তার পর শুরু হয়েছে মারামারি। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে স্থানীয় পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, আর বিজেপি নেতাদের অতি সক্রিয় মদত। রামযশ কলেজের ঘটনাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। এর মধ্যে একটা প্যাটার্ন আছে।
একটি প্রশ্ন প্রথমেই ওঠা স্বাভাবিক। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবিভিপি ছাত্র ইউনিয়ন চালায়, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও প্রশ্নাতীত, সেখানেই তারা এ রকম গাজোয়ারি করছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা লুকিয়ে আছে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রে। একশোর ওপর কলেজ, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট বিভাগ, এবং দূরশিক্ষার কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় লাখখানেক ছাত্রছাত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। স্বভাবতই এখানে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এবিভিপি বা সঙ্ঘ পরিবার এই বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের এবং তাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে একটা প্রশ্নহীন আনুগত্য আশা করে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তারা আরও বড় একটি জনগোষ্ঠীকে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবনার আওতায় আনতে চায়। দরকার হলে হিংসা ছড়িয়ে, হুমকি দিয়ে। কিন্তু এর একটি বৃহত্তর প্রেক্ষিতও আছে।
সমাজতাত্ত্বিক সতীশ দেশপাণ্ডে-র মতো অনেকেই দেখিয়েছিলেন কীভাবে গত দুই দশকে আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চরিত্র আমূল বদলেছে সংরক্ষণ বা ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন’-এর ফলে। যদিও ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণ ক্রুটিমুক্ত নয়, কিন্তু সংরক্ষণের ফলে, বিশেষ করে মণ্ডল কমিশন-এর পরে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক পৌঁছেছেন যাঁরা এর আগে সেখানে পড়ার কথা ভাবতেও পারতেন না। এই সব শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী এমন অনেক অনেক ইতিহাসকে বয়ে এনেছেন, এমন অনেক প্রশ্ন তুলেছেন যেগুলো আগে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি। এর ফলে আমাদের নতুন করে শিখতে হয়েছে কী পড়ব, কেন পড়ব, আর কী ভাবেই বা পড়ব। এর সঙ্গে যোগ করুন আরও নতুন নতুন প্রশ্ন নিয়ে হাজির হওয়া নারীবাদী বা অন্য-যৌনতার ছাত্রছাত্রীদের। লিঙ্গচেতনা বা যৌনতা নিয়ে আমরা সবাই নতুন করে ভাবছি, নতুন নতুন নানা প্রসঙ্গ তুলছি। এগুলো নিয়ে বিতর্ক, আলোচনা চলছে, আর এর মধ্যে দিয়ে এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা তৈরি হচ্ছে।
এইখানেই সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে সংঘাত বাধছে। ঐতিহাসিক ভাবে সঙ্ঘ পরিবারের হাতে একটি-ই বৌদ্ধিক অস্ত্র আছে— জঙ্গি ন্যাশনালিজম। আরএসএস ন্যাশনালিজম নিয়ে প্রশ্ন বা বিতর্ক পছন্দ করে না। তাদের স্বপ্নের দেশে সবাইকে একই অনুশাসন মেনে চলতে হবে, সবাইকে একে অপরের নির্ভুল কার্বন কপি হতে হবে। যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছিলাম তার সঙ্গে এই সঙ্ঘবাদের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। যে ছাত্রছাত্রীরা যুক্তি-বুদ্ধি আর ইতিহাসের আলোয় সব কিছু পরখ করে দেখতে চায়, তাদের কাছে এই গড্ডলিকা ন্যাশনালিজমের না আছে কোনও আবেদন, না কোনও প্রাসঙ্গিকতা। তারা প্রশ্ন করতে চায়, ভাবতে চায়, নতুন নতুন দাবি জানাতে চায়। তারা যে নতুন সমাজের কথা কল্পনা করে, সেখানে সঙ্ঘ নয়, আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র পথ।
এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে একটি দ্বিতীয় প্রসঙ্গ। গত বছর দুয়েকের মধ্যে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার অধিকাংশই ঘটেছে সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে মানববিদ্যা ও সমাজবিজ্ঞান পড়ানো হয়। যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে মূলত কারিগরি শিক্ষা বা ম্যানেজেরিয়াল স্কিলস্ শেখানো হয়, সেখানকার শিক্ষাকে চাকরি বা ব্যক্তিগত সাফল্যের কাজে লাগানো যায়, কিন্তু সেই ঘরের সঙ্গে বাকি বাড়ির বিশেষ সম্পর্ক নেই। অন্য দিকে, মানববিদ্যা ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আমাদের দৈনন্দিন জীবন, তার ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ, এই নিয়েই চর্চা। এখানে অধীত বিদ্যা একান্তই জীবন-নির্ভর। তাই এখানে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে, বিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞান চর্চা বাড়ে, আর নতুন নতুন বিষয় পড়ুয়াদের মনে আলোড়ন তোলে। আর তাই, গত বছর দুয়েক, মতাদর্শগত যুদ্ধটা বেধেছে সঙ্ঘ আর ছাত্রদের মধ্যে। এমনকী এও বলা যায় যে, এই সময়ে সঙ্ঘ পরিবারের একমাত্র কার্যকর প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ, কোনও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল নয়।
এইখানেই সঙ্ঘ এবং এবিভিপি-র লড়াইটা বার বার হেরে যাচ্ছে। যে দলিত ছাত্রটি পাহাড়প্রমাণ বাধা তুচ্ছ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে, যে ছাত্রী সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দিনের পর দিন দাঁত চেপে ‘পিঞ্জরা তোড়’-এর মতো আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তাদের স্রেফ গায়ের জোরে থামানো কঠিন। গত এক বছরে রোহিত ভেমুলা, কানাইয়া কুমার, বা রিচা সিংহ-রা বার বার খবরের শিরোনামে এসেছে, কিন্তু তাদের পিছনে আছে এই রকম অসংখ্য মুখ যারা রোজ ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের জ্ঞানচর্চার সঙ্গে রাজনৈতিক বোধের মিশেল ঘটিয়ে চলেছে, যাদের ছাড়া এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় কল্পনা করাই কঠিন। এরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরকে, নিজেদের বিষয়কে নিজেদের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে ও বুঝতে চায়। প্রতিদিন নিজেদের দাঁড় করায় প্রশ্নের মুখে, জর্জরিত হয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে, খুঁড়ে দেখতে চায় নিজের জীবনের চূড়ান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা-বাসনাগুলোকে। হায়দরাবাদ, দিল্লি, যাদবপুর, ইলাহাবাদ, রাঁচি, মহেন্দ্রগড় বা যোধপুরে যে ছাত্রছাত্রীরা বার বার সঙ্ঘ পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া একবগ্গা ন্যাশনালিজম-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে তাদের শুধু পেশিশক্তি দিয়ে থামানো কঠিন। তারা ছড়িয়ে পড়বে আপনার আমার চার পাশে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসবে অনেকেই শিক্ষক বা গবেষক হিসেবে। আজ যে যুদ্ধটা সঙ্ঘ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চলছে, তা ছড়িয়ে যাবে বৃহত্তর পরিসরে। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস ও আমাদের ছাত্রসমাজ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy