শ্রীভূমির পুজা উদ্বোধনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত বৎসর যাহা নিতান্ত মশকরা ছিল, এই বৎসর তাহাই ঘোর বাস্তব হইয়াছে। তৃতীয়া-চতুর্থী নহে, এমনকি মহালয়াও নহে, তাহারও এক দিন পূর্বে উদ্বোধন হইল একাধিক সর্বজনীন দুর্গা পূজার। শ্রীরামচন্দ্র আর অকালবোধনের কী জানিতেন! মানুষও ঝাঁপাইয়া পড়িয়া ঠাকুর দেখিয়াছে। নবমীর নিশিও ইদানীং আর কাঁদে না, কারণ পঞ্জিকার পাতায় যাহাই লিখুক, দুর্গা এখন প্রায় লক্ষ্মীপূজা পার করিয়া বাড়ি ফিরেন। কেহ বলিতেই পারেন, তাহাতে মন্দ কী? যত দিন পূজা, তত দিনই বহু সংখ্যক মানুষের রুজিরুটির সংস্থান। পথের ধারে যাঁহারা এগ রোল আর কোল্ড ড্রিঙ্ক বেচিতেছেন, যাঁহারা রিকশা টানিয়া কিঞ্চিৎ বেশি ভাড়া দাবি করিতেছেন এবং পাইতেছেন, এবং তাঁহাদের ন্যায় অন্যদের পূজা দীর্ঘস্থায়ী হইলেই লাভ। যাঁহারা প্যান্ডেল বাঁধেন, প্রতিমা গড়েন, আলো সাজান— রাজ্যে পূজার সংখ্যা যত বাড়িবে, গণেশ হইতে বজরঙ্গবলী, যত দেবতার আগমন ঘটিবে, তাঁহাদের রোজগারও সেই অনুপাতে বাড়িবে। গরিব মানুষের আয় বাড়িলে আপত্তি করিবে কোন পাষাণহৃদয়? এবং, শুধু তো তাঁহাদের আয়বৃদ্ধি নহে, কেনাবেচা চলিলে, কর্মসংস্থান হইলে রাজ্য অর্থনীতিরও লাভ। কাজেই, যদি বা পূজা তহবিলের একটি অংশ মদ্য-বিরিয়ানিতে বেহিসাবি খরচ হইয়াও যায়, তবুও পূজায় লাভ।
কিন্তু, সব লাভেরই একটি বিপরীত দিক থাকে। পূজার লাভেরও আছে। পূর্বে সপ্তমী হইতে রাজ্যে কাজকর্ম বন্ধ হইত। এখন মহালয়া হইতে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অবধি যাবতীয় কাজ শিকায় উঠে। গণেশ চতুর্থীতেও কাজ বন্ধ হয়। রামনবমীতে তো বটেই— কে আর অস্ত্রমিছিলের মধ্য দিয়া কাজে যাইবার সাহস করিবে! যাবতীয় উৎপাদনশীল কাজ বন্ধ হইয়া যাইবার এই যে ক্ষতি, ইহাই— অর্থনীতির ভাষায় বলিলে— উৎসবের ‘অপর্চুনিটি কস্ট’, বা বিকল্প খরচ। অর্থাৎ, উৎসব করিতে গিয়া রাজ্য যে সম্ভাবনাটিকে ছাড়িয়া দিল, তাহা হইতে সম্ভাব্য আয়ের পরিমাণ। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নহে, মহারাষ্ট্র হইতে ম্যাসাচুসেট্স্, দিল্লি হইতে বার্লিন, যেখানেই উৎসব হয়, সেখানেই এই অপর্চুনিটি কস্টও থাকে। অপর্চুনিটি কস্টের হিসাব ভিন্ন অর্থনীতির গত্যন্তর নাই।
এই প্রসঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গের কথা ভাবিলে সকলেই বুঝিবেন, যে রাজ্যে শিল্প নাই, বাণিজ্য নাই, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলিতে মূলত যাহা আছে, তাহার নাম সিন্ডিকেট— সেখানে দুর্গাপূজা এবং অন্যান্য পুরাতন-নূতন উৎসব বাবদ যে দিনগুলি নষ্ট হয়, সেই দিনগুলি যদি কাজেও কাটিত, রাজ্য অর্থনীতির ইতরবিশেষ হইত না। অর্থাৎ, এই রাজ্যে উৎসবের অপর্চুনিটি কস্ট নিতান্ত কম। গোটা দেশে আর কোথাও এত কম বিকল্প ব্যয়ে উৎসব আয়োজিত হইতে পারে কি না, তাহা ভাবিয়া দেখিবার। অতএব, উৎসব যদি কোথাও করিতেই হয়, তবে তাহা পশ্চিমবঙ্গে। গোটা দেশের কথা ভাবিলে, এই রাজ্যের উৎসবেই অর্থনীতির সর্বাপেক্ষা কম ক্ষতি। সুতরাং, দেশের উৎসব-রাজধানী হইয়া উঠিবার দাবি যদি কোনও রাজ্য করিতে পারে, তবে তাহা পশ্চিমবঙ্গ। কর্তারা ভাবিয়া দেখিতে পারেন, আসন্ন বাণিজ্য সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের উৎসব সম্ভাবনাকে বিপণন করা যায় কি না। অন্য রাজ্য কাজ করুক, শিল্প আনুক, বাণিজ্যে অগ্রসর হউক। পশ্চিমবঙ্গের জন্য থাকুক অনন্ত উৎসবের অপরিসীম আনন্দ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy