কৌশিক সেনের ‘আত্মপতনের বীজ’ (২০-৪) আমাকে বিশেষ লজ্জায় ফেলেছে। কৌশিকবাবু লিখেছেন, ‘‘আর আমরা যারা অতীব সাধারণ নাট্যকর্মী, যখন আমাদের শহরে বসে, এই সময়ের সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান মানুষ, অসামান্য কবি শঙ্খ ঘোষকে (ছবিতে) অসম্মান করে ‘ক্ষমতা’।’’ প্রশ্ন রেখেছেন তিনি, ‘‘শঙ্খ ঘোষের অসম্মানে আমরা এই রাজ্যের সাংস্কৃতিক কর্মীরা কী করতে পারি? পাল্টা স্লোগান? মিছিল? প্রেস কনফারেন্স? পাল্টা মিছিল?’’ লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি, কিছু নাট্যকর্মীকে একজোট করে চেষ্টা করা হয়েছিল একটি প্রতিবাদপত্র প্রকাশ করার। কিন্তু পারা যায়নি, নানা কূট প্রশ্ন এসে প্রয়াসটিতে জল ঢেলে দিল। অথচ বাংলা নাট্যের গোটা জগৎটাই ওই মানুষটির কাছে যে কতটা ঋণী তা আমাদের চেয়ে বেশি কে জানে? নাট্য বিষয়ে তাঁর অসাধারণ সব আলোচনা নিবন্ধ আমাদের আলো দেখিয়েছে, আপাত-দুরূহ রবীন্দ্রনাটক ও নাট্যের দ্বার খুলে দিয়েছে আমাদের সামনে। অভিনয়ে বা অনুষ্ঠানে তাঁকে পাওয়ার জন্য নাট্যদলগুলি অহরহ জ্বালাতন করেছে তাঁকে, তিনি সস্নেহ প্রশ্রয়ে সাড়া না দিয়ে পারেননি, শারীরিক অসুস্থতা উপেক্ষা করেও। তাঁর একটি প্রশংসাসূচক মন্তব্য বা বাক্য থিয়েটারের বিজ্ঞাপনে প্রকাশ করতে পারলে ধন্য বোধ করেছে নাট্যদলগুলি।
সেই মানুষটি অপমানিত হলেন। দু’এক জন ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ কিছু বললেনই না। অবাক হয়ে দেখলাম, প্রতিবাদের পথ এড়িয়ে যাওয়ার নানা কৌশল, নানা অজুহাত। অনুব্রত মণ্ডল মশাইকে মজার লোক, গাঁয়ের লোক, রাজনীতির লোক ইত্যাদি প্রশ্রয়ী বিশেষণে অভিহিত করে অনেকে বললেন, কী দরকার ছিল একে ঘাঁটাবার? ওঁর মতো মানুষকে কি মানায় একে আক্রমণ করা? বিষয়টি লঘু করে দেওয়ার কৌশলী প্রয়াস! শিক্ষামন্ত্রীও বলে দিলেন, ওটা নাকি ছিল ব্যক্তি-আক্রমণ। তিনি রাজ্যের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক-অধ্যাপকের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
বাহুবলী অনুব্রতবাবুর লোক-কবিসুলভ উচ্চারণ অনেকেই বুঝেও না-বোঝার ভান করলেন, আর শঙ্খবাবুর কবিতাও কে কতটা বুঝেছেন, সন্দেহ আছে। কিন্তু ডেভিডের সঙ্গে গোলিয়াথকে লড়িয়ে দিয়ে সবাই বেশ খানিকটা মজা উপভোগ করে নিলেন। বিষয়ের গভীরতায় কেউ প্রবেশ করার চেষ্টাও করলেন না। রবীন্দ্র-নজরুলের নামটুকু মাত্র শোনা অনুব্রতবাবুও কিছু অবাঞ্ছিত কথা বলে ফেললেন। দেশের এক জন বড় মাপের মানুষ এবং শ্রদ্ধেয় কবি অপমানিত হলেন। তাঁর মানরক্ষার জন্য জয় গোস্বামীকে কবির একটি বায়োডেটা পেশ করতে হল অনুব্রতবাবুর জ্ঞাতার্থে। জনৈক সাহিত্যিক বললেন, কিছুই বলার নেই— কবিতাটি রাজনীতিদোষে দুষ্ট ছিল!
সেই ১৯৫১ সালে, কবি শঙ্খ ঘোষের বয়স তখন সবে উনিশ। কোচবিহারে খাদ্যের দাবিতে একটি মিছিলে ১৬ বছরের একটি মেয়েকে গুলি করে মারল স্বাধীন ভারতের পুলিশ। সে খবর শুনে যন্ত্রণার্ত কবি লিখলেন ‘যমুনাবতী’— নিভন্ত এই চুল্লিতে মা, একটু আগুন দে...। এর জন্য কবিতার শুদ্ধতায় বিশ্বাসী বুদ্ধদেব বসুর নিন্দাও সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ-সহ বিশ্বের বহু বড় কবি-সাহিত্যিকই রাজনীতিকে এড়িয়ে যেতে চাননি কখনওই।
‘ফেসবুক’ এমন একটি মাধ্যম, যেখানে যে কেউ যা খুশি লিখে পার পেয়ে যেতে পারে। এক সাংবাদিক লিখলেন, এই কবি কোথায় ছিলেন মরিচঝাঁপির সময়? সাংবাদিকটি খবরও রাখেন না যে, ওই সময় দু’দুটো কবিতা লিখেছিলেন কবি। ‘তুমি আর নেই সে তুমি’ এবং ‘উল্টোরথ’। জানতে গেলে পড়তে হবে কবির লেখা ‘কবিতার মুহূর্ত’ বা মধুময় পালের ‘মরিচঝাঁপি’। অতিচালাক কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, উনি কি তা হলে বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়লেন? তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার আগে জানাতে হবে যে দেশের কোনও এক প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে উনি কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সরস্বতী সম্মান’ গ্রহণ করতে অসম্মত হয়েছিলেন এবং সেই বাবদ প্রাপ্য বড় অঙ্কের পুরস্কারমূল্যের সবটাই দান করে দিয়েছিলেন একটি বিদ্বৎপ্রতিষ্ঠানে। সবাই জানে, নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনে নাগরিক সমাজের প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি।
তেমনই আয়লা-দুর্গতদের জন্য রাস্তায় কৌটো ঝাঁকিয়ে অর্থ সংগ্রহ, দুর্গতদের কাছে স্বয়ং গিয়ে তা পৌঁছে দেওয়া— সবই করেছিলেন। হায় রে অকৃতজ্ঞ বাঙালি!
কৌশিক এ-ও বলেছেন— এক কালের প্রতিবাদী বিশিষ্টজনদের বর্তমান ‘হিরণ্ময় নৈঃশব্দ্য’-এর জন্য কিছু মানুষ যখন তাঁদের ‘‘যাবতীয় গুণাবলি অস্বীকার করে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন, তখন বুঝতে পারি শাসকদের বাঁধাধরা বুলির যে হিংস্রতা, তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে বিরোধী কণ্ঠস্বরেরও একটা বাঁধা গত আছে, এবং সেটাও ভয়ঙ্কর। সেই ‘ভিড়’টাও অতীব বিপজ্জনক।’’ ধন্যবাদ কৌশিককে। আসলে ‘দুর্ভাগা দেশ’-এর যে মেরুদণ্ডহীন ‘ভিড়’ নিজেরা প্রতিবাদ করতে পারে না, তারা ‘বীর’ খুঁজে বেড়ায়, আর না পেলে ‘অতীব বিপজ্জনক’ হয়ে ওঠে। এই পত্রিকারই পাতায় প্রদীপ বসু কিছু দিন আগে বলেছিলেন, দেশের এই ‘হিংস্রতম রাজ্য’-এ সাধারণ মানুষকেই মেরুদণ্ডী হয়ে উঠতে হবে, বিদ্বজ্জনরা অপ্রাসঙ্গিক। আমি যোগ করি— শাসক বিদ্বজ্জনদের কেয়ারই করে না, অক্লেশে ফুটিয়ে দেয়। আর ‘ভিড়’ সম্পর্কে বহু দিন আগে শঙ্খ ঘোষই বলেছিলেন: আরো কত ছোটো হব ঈশ্বর/ ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে!/ আমি কি নিত্য আমারও সমান/ সদরে, বাজারে, আড়ালে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy