দেশপ্রেমিক: রণক্ষেত্রে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ইম্ফল সীমান্ত
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মরণীয় দিনগুলির মধ্যে ১৪ এপ্রিল ১৯৪৪ এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পঁচাত্তর বছর আগে এই দিনে আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্নেল সৌকত মালিক ইম্ফল থেকে অল্প দূরে ময়রাং-এ ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। মিলিটারি ইতিহাসের বইতে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মণিপুরের বিষেনপুর ময়রাং সেক্টরে প্রবল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল। এলাকার নিখতুখং গ্রামে হাড়গোড়ের পাহাড় জমে গিয়েছিল। ফলে নাকি ভূতের উপদ্রবও হয়েছিল। গ্রামবাসীরা শান্তিস্বস্ত্যয়ন করেছিলেন। এক ইংরেজ জেনারেল লিখে গিয়েছেন যে ঘোরতর যুদ্ধের মধ্যে তিনি হঠাৎ দেখেন গ্রামের এক কুটিরের দরজায় ভারী সুন্দর রাধাকৃষ্ণের ছবি আঁকা রয়েছে। জেনারেল সাহেবের মনে শান্তির প্রলেপ পড়েছিল।
অনেক বছর বাদে, আমি যখন তথ্যের সন্ধানে মণিপুরে যাই তখন সেখানে কংগ্রেস সরকারে মন্ত্রিত্ব করছেন কৈরেঙ্গ সিংহ ও নীলমণি সিংহ। এঁরা দু’জনেই আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিক ছিলেন। ময়রাং-এ নীলমণি সিংহের নিজের ছোট বাড়িটিতে ছিল সৌকত মালিকের অফিস। তিনি আমাদের বাড়িটি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাড়িটি তার টিনের দেওয়ালে বুলেটের দাগ নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ইম্ফলের যুদ্ধে পরাজয়ের পর আইএনএ-র সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করে তাঁরা রেঙ্গুনে পৌঁছন।
ইম্ফল অভিযানের মিলিটারি নাম ছিল অপারেশন-ইউ। ১৪ এপ্রিল সৌকত মালিকের ইউনিট বাহাদুর গ্রুপের আজাদি সৈনিকরা আনন্দে আত্মহারা। তাঁদের যুদ্ধে সাথি জাপানের ফিফটিনথ আর্মির সেনারাও উৎফুল্ল। তাঁরা বুঝতে পারছেন যে আর দু’চার দিনের মধ্যেই ইম্ফল শহরের পতন হবে। ইম্ফল শহর ইংরেজদের বড় ঘাঁটি চার দিক থেকে অবরোধ করা হয়েছে, তাদের পালাবার কোনও পথ নেই। কোহিমার দিক থেকে অবরোধ করে আছে শাহনওয়াজ খানের নেতৃত্বে সুভাষ ব্রিগেড। বিষেনপুর ময়রাং সেক্টরে সৌকত মালিকের বাহাদুর গ্রুপ। প্যালেল-টামু পার্বত্য পথে পৌঁছে গিয়েছেন আইএনএ’র ফার্স্ট ডিভিশনের কমান্ডার মহম্মদ জমান কিয়ানি। সে দিক থেকে কর্নেল এনায়েত কিয়ানি গাঁধী ব্রিগেড নিয়ে মাঝে মাঝেই প্যালেল আক্রমণ করছেন। এক বার তিনি প্যালেল বিমানবন্দর দখল করে ফেলেন। জেনারেল ফুজিয়ারা এই সময়ে মায়ানমারের মেমিয়োতে এক মিলিটারি বৈঠকের কথা আমাদের বলেছেন। বৈঠকে নেতাজি বলেছিলেন, ইম্ফল অবরুদ্ধ না করে অন্তত একটা দিক খুলে রাখা হোক, ইংরেজরা যাতে পলায়ন করতে পারে। কিন্তু জেনারেল মুতাগুচির ইচ্ছা, সমগ্র ব্রিটিশ বাহিনী-সহ ইম্ফল তিনি দখল করবেন। পরবর্তী কালে সকলে স্বীকার করেছেন, এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ইম্ফল অভিযান ব্যর্থ হল, এবং মিলিটারি ইতিহাসে ‘ইম্ফল ফিয়াস্কো’ নামে পরিচিত হল।
আমাদের ইম্ফলে থাকার সময়ে নীলমণি সিংহ স্বয়ং সব দ্রষ্টব্য জায়গা দেখিয়েছিলেন। আমাদের বর্মা সীমান্তে মোরে পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। সবচেয়ে অভিভূত হয়েছিলাম যে দিন তিনি আমাকে ও শিশির বসুকে নিয়ে বিষেনপুরে একটি ছোট পাহাড়ে উঠতে শুরু করলেন। বেশ কিছু দূর ওঠার পর দেখলাম সামনে একটি ক্ষুদ্র পাথর বসানো আছে, তাতে খোদাই করা: ‘আইএনএ-র অজানা সৈনিকদের স্মরণে।’ আমরা সেখানে কিছু ক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি পরে দেখেছি যে ইম্ফলে কমনওয়েলথ-এর পক্ষ থেকে ইংরেজ সৈনিকদের জন্য অতিসুন্দর সমাধিস্থল আছে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র পাথর সে দিন আমাদের অভিভূত করেছিল।
নীলমণি সিংহ এক দিন আমাদের বললেন, সৌকত মালিকের অধীনে বাহাদুর গ্রুপে কাজ করেছেন, এমন এক মণিপুরি সৈনিক আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে জানলাম, তিনি ময়রাং-এর অধিবাসী। তাঁর নাম— নাকি মহম্মদ। তিনি মণিপুরি হওয়াতে সৌকত মালিক তাঁকে খবরাখবর সংগ্রহ করতে শত্রু শিবিরেও পাঠাতেন। সৌকত তাঁকে বলেছিলেন, তোমার পরিবার তো ময়রাং-এ থাকে, ইচ্ছা হলে বাড়িতে দেখা কোরো। তবে, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি কখনও বাড়িতে যাননি। কিন্তু এই ঘন ঘন যাতায়াতের মধ্যে এক স্বদেশীয় সিআইডি-র হাতে ধরা পড়ে যান। এখন তিনি খুব সামান্য চাকরি করেন ও দরিদ্র জীবন যাপন করেন। মনে কি কোনও কষ্ট হয়, জিজ্ঞাসা করাতে বলেছিলেন, না, দেশ তো স্বাধীন হয়েছে।
সৌকত মালিক আদতে পঞ্জাবের বাহাওয়ালপুরের মানুষ। তিনি ছিলেন এক বর্ণময় চরিত্র। তাঁর সম্পর্কে নানা কাহিনি প্রচলিত। একটি কাহিনি গুরুবক্স সিংহ ধিলোঁ আমাদের বলেছিলেন। ময়রাং দখলের পর সৌকত রেঙ্গুনে এলে নেতাজি একটি বড় সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে জাপানের ও বর্মার পদস্থ অফিসাররাও নিমন্ত্রিত। পানাহারের পরে সৌকত কিঞ্চিৎ মত্ত হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝেই ‘নেতাজি’ বলে চেঁচিয়ে উঠছিলেন। এক বার তো এমন করলেন যে নেতাজি তাঁর দিকে ফিরে তাকালেন। তার পর অন্য দিকে ফিরে বা ম’র সঙ্গে আলাপ করতে লাগলেন। হবিব-উর রহমান এসে তাড়াতাড়ি সৌকতকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। পর দিন খুব ভোরবেলায় সৌকত নেতাজির বাসগৃহে হাজির। এডিসি শামসের সিংহকে বলে নেতাজির সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কোমর থেকে রিভলবার খুলে নেতাজির সামনে টেবিলে রাখলেন ও বললেন— ‘‘কাল আমি যা ব্যবহার করেছি তা আইএনএ অফিসারের উপযুক্ত নয়। আমি আর এ প্রাণ রাখব না। আত্মহত্যা করা মহাপাপ। কিন্তু আপনার হাতে শাস্তি পেলে আমি বেহেশ্তে যাব।’’
নেতাজি শান্ত ভাবে চেয়ে বললেন, ‘‘সৌকত, তোমার কী প্রয়োজন জানো? একটু বিশ্রাম। তোমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় গিয়েছে, বিশ্রাম নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ ধিলোঁ বলেছিলেন, এর পরেই তাঁর সঙ্গে রেঙ্গুনের এয়ারপোর্টে সৌকতের দেখা। তিনি বললেন, নেতাজি তাঁকে ব্যাঙ্ককে ছুটি কাটাতে পাঠাচ্ছেন, খরচ করার জন্য কিছু অর্থও দিয়েছেন। সৌকত মালিকের ছিল দিলদরিয়া মেজাজ। ধিলোঁকে সেই অর্থের ভাগ দিতে চাইলেন। ধিলোঁর প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে দুটো নোট ওঁর পকেটে গুঁজে দিয়ে সৌকত ব্যাঙ্ককের প্লেন ধরতে চলে গেলেন।
ইম্ফলের যুদ্ধে সৌকত মালিক বীরযোদ্ধা হিসেবে এক উজ্জ্বল নাম। তেমনই এক হাসিখুশি, মিশুকে মানুষ হিসেবে সহযোদ্ধাদের কাছে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। মণিপুর রণাঙ্গনে বীরত্বের জন্য নেতাজি সৌকত মালিককে ‘সর্দার-এ-জঙ্গ’ উপাধি প্রদান করেন।
নীলমণি সিংহ যখন আমাদের মণিপুরের বিভিন্ন রণক্ষেত্র ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তখন বললেন, নেতাজি যুদ্ধের মধ্যে সীমান্ত পার হয়ে চূড়াচাঁদপুরে প্রবেশ করেছিলেন। সীমান্ত-সংলগ্ন চূড়াচাঁদপুর দেখতে গিয়ে আমাদের এক বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। নেতাজিকে সেই সময় দেখেছিলেন, এমন কেউ কি আছেন— এই প্রশ্নের জবাবে জানা গেল কাছেই সাইকট গ্রামের রাজা অর্থাৎ জনজাতি প্রধান, নাম কলবেল, এখনও আছেন। তাঁর সঙ্গে আমার ও শিশির বসুর একটি অবিস্মরণীয় সাক্ষাৎকার হল। তিনি বললেন, চূড়াচাঁদপুরে আজাদি সৈনিকদের একটি ছাউনি ছিল। সেটা পরিদর্শন করতে নেতাজি এসেছিলেন। একটি পাহাড়ি এলাকায় মস্ত ছাতিম গাছের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, এই গাছের তলায় নেতাজি বসেছিলেন। ছাউনি থেকে বিশাল সেনার দল পাহাড়ের ঢালুতে বসেছিল। সে রাতে খুব চাঁদের আলো। রাজা কলবেল সৈনিকদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, নেতাজিকে দিলেন এক গ্লাস দুধ। নেতাজি বললেন, ‘‘আমার সৈনিকেরা যা খায়, আমিও শুধু তা-ই খেয়ে থাকি।’’ তবুও মাননীয় অতিথির প্রতি জনজাতি প্রথা মেনে তিনি সেই দুধ গ্রহণ করলেন। নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘তোমরা আমাদের সৈনিকদের খাদ্যসামগ্রী দিয়ে অনেক সাহায্য করেছ, দেশ স্বাধীন হলে আমরা সে কথা মনে রাখব।’’ এক টুকরো কাগজে কিছু লিখে তিনি ওঁর হাতে দিয়েছিলেন। ইংরেজরা ফিরে এসে এলাকা দখল করলে রাজা কলবেল একটি তোরঙ্গের মধ্যে সেই কাগজ রেখে মাটির তলায় লুকিয়ে রাখেন। তোরঙ্গে জল ঢুকে সব কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যায়।
শাহনওয়াজ খান বলেছেন, নিষেধ না মেনে নেতাজি যুদ্ধের মধ্যে সীমান্তবর্তী অঞ্চল পরিদর্শন করতেন, মাঝে মাঝে ভারতে ঢুকেও পড়তেন। নাগাল্যান্ডেও এ বিষয়ে জনশ্রুতি আছে। গবেষকের পক্ষে ক্রসচেকিং না করে তথ্য গ্রহণ করা সম্ভব নয়। রাজা কলবেলের মুখে সরাসরি তাঁর অভিজ্ঞতা শুনে আমরা রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। সে বার ইম্ফল ছেড়ে আসার সময় মনে হয়েছিল, এখানকার গাছপালা, পাহাড়-পর্বত কত ইতিহাসের সাক্ষী, কত শহিদের রক্তরঞ্জিত এই পবিত্র ভূমি। তাঁদের উদ্দেশে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy