কা ল বলছিলাম ত্রুটিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থার কথা। এই প্রসঙ্গে, রোগী ও তার পক্ষের লোকজনের শিক্ষা ও সচেতনতার জন্যও কিন্তু প্রচুর সংকট তৈরি হয়। এমনিতেই রোগীর মনে ডাক্তার বিষয়ে আস্থার অভাব। তার উপর ভুল তথ্য, চার পাশের লোকজনের ভুল পরমার্শ, এমনকী অন্যান্য ডাক্তার ও প্রতিযোগী হাসপাতাল থেকে আসতে-থাকা নানা উপদেশ— সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। অথচ হয়তো এই পরিস্থিতি অনভিপ্রেত, অপ্রয়োজনীয়: ডাক্তারদের অনেকেই হয়তো পেশাগত ভাবে যথেষ্ট আন্তরিক, নিজের নিজের কাজে যথেষ্ট দক্ষ। কিন্তু মাঝখান থেকে অনাস্থার একটা দুস্তর সমুদ্র তৈরি হয়ে যায়।
ডাক্তার আর রোগীর মধ্যে সামাজিক দূরত্বটাও অগ্রাহ্য করা যাবে না। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সাধারণত বিস্তর ব্যবধান। তার থেকেই একটা অসম ক্ষমতার সূত্রপাত। ডাক্তাররা অনেক সময় পরোক্ষ ভাবে তাঁদের মনোভাব দিয়ে এই ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দেন, রোগীকে ‘ছোট’ বোধ করান। সব মিলিয়ে যে পরিবেশ তৈরি হয়, তাতে অনাস্থা বহু ক্ষেত্রে পরিণত হয় ক্ষোভে। আর যেখানে হামলাকারীরা হামলা করার সুযোগ পায়, সেখানে অনাস্থা দ্রুত গড়িয়ে যায় হিংসাত্মক আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণের দিকে।
উপরে যে বিষয়গুলি আলোচনা হল, তার সব কয়টি মিলিয়েই জনসাধারণ ও বেসরকারি চিকিৎসাক্ষেত্রের মধ্যে সম্পর্ক বড় জটিল। কোনও একটি বিষয়কে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে জটিলতার পুরো ছবিটা ধরা যাবে না। অথচ আমরা আগেই আলোচনা করেছি কেন বিভিন্ন কারণে ‘ফর-প্রফিট’ প্রাইভেট সেক্টরকে চিকিৎসাক্ষেত্রে থাকতেই হবে, গত্যন্তর নেই, কিংবা কেন মানুষের চিকিৎসা-বিষয়ক ক্রম-পরিবর্তনশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে সরকারি হাসপাতাল সমাজের সমস্ত রকম প্রয়োজন মেটাতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে একটাই পথ বাকি থাকে। যে কোনও পন্থায় দুই পক্ষের অনাস্থার পরিমাণটা কমানো। সংকটের সমাধান করা।
সমাধানের জন্য দরকার, আলোচিত বিষয়গুলিকে এক এক করে দেখা, ও তাদের প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। হাসপাতালের মালিক, হাসপাতালের ম্যানেজার, ডাক্তার, বিমা কোম্পানি, রোগী কিংবা সমাজবিরোধী দুর্বৃত্তবৃন্দ: কোনও একটিমাত্র পক্ষকে অব্যবস্থার জন্য আলাদা করে দায়ী ঠাউরালে চলবে না, কোনও একটি পক্ষের উপর সমাধানের ভার চাপিয়ে দিলেও চলবে না। সব পক্ষের মধ্যে আলোচনা চাই। এমন নীতি চাই যাতে সব পক্ষের প্রতি ন্যায় বিচার হয়। নিরপেক্ষ তদারক-কমিটি চাই। মাথা-গরম উগ্র প্রতিক্রিয়া ঠেকানো চাই। মানুষের মধ্যে সচেতনতার প্রসার চাই। কিন্তু এ সবই প্রাথমিক ছোট ছোট পদক্ষেপ। চটজলদি ফল মিলবে না। চিকিৎসার ক্ষেত্রটি ভারী গুরুতর: সমাজ ও চিকিৎসক গোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্বটা যেন কোনও মতেই অনতিক্রম্য খাদে পরিণত না হয়, সেটা দেখতে হবে। লম্বা রাস্তা। কী ভাবে রাস্তাটা ছকা যেতে পারে, সেটা আলাদা আলোচনার বিষয়।
শেষ করি সেই পুরনো কথাটা দিয়ে। শুরুর শুরুটা কিন্তু এক ধরনের মানসিক পরিবর্তন। ডাক্তারদের মধ্যে, এবং একই সঙ্গে চিকিৎসা-ব্যবসায়ে যাঁরা লগ্নি করছেন, তাঁদের মধ্যে এই মানসিক পরিবর্তনটা আসা দরকার। তাঁদের অনুভব করা দরকার যে তাঁরা কেবল একটা দায়িত্ব পালনে বাধ্য নন, রোগী ও বৃহত্তর সমাজের কাছে তাঁরা একান্ত ভাবে দায়-বদ্ধ। দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। পার্থক্যটা সূক্ষ্ম হতে পারে, কিন্তু অত্যন্ত গুরুতর। যে সমাজে ডাক্তারকে রক্ষা করার জন্য নিরাপত্তাকর্মীর প্রয়োজন, সেই সমাজে আসলে গভীর ক্ষত। সেই ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্য আমরা ডাক্তাররা সম্মিলিত ভাবে প্রথম পদক্ষেপ করতে পারি না?
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy