সব মিলিয়ে ষোলো বছর। ১৯৪৭ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে ২১ ডিসেম্বর, ১৯৬৩। স্বাধীনতার পরে পরেই শুরু, বিদায় নেওয়ার কয়েক মাস আগে শেষ। মাসে দু’টি করে চিঠি লিখতেন জওহরলাল নেহরু, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের। ষোলো বছরে প্রায় চারশো চিঠি— অর্থাৎ অস্বাভাবিক কর্মব্যস্ততার মধ্যেও রুটিনে বিশেষ ছেদ পড়েনি।
প্রথম চিঠিতেই নেহরু লিখেছিলেন, ‘‘আমি জানি, দেশে একটা ধারণা প্রচলিত হয়েছে... যে, কেন্দ্রীয় সরকার যেন কিছুটা দুর্বল, তারা মুসলিমদের তোষণের নীতি অনুসরণ করছে। এটা সম্পূর্ণ বাজে কথা। দুর্বলতা বা তোষণের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’’
সংখ্যালঘু তোষণের ‘ধারণা’ দশকের পর দশক ধরে ফুলে ফেঁপে উঠে কোথায় পৌঁছল, তা আমরা জানি। যাঁরা সেই ধারণাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পাকা ফসল ঘরে তুলছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য বিধেয় দুইই পরিষ্কার। কিন্তু তার উল্টো দিকে, ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা ধরে যাঁরা স্বাধীন ভারতের রাজপথে চলা শুরু করেছিলেন? তাঁদের সমস্ত অঙ্কে ক্রমাগত এমন ভয়ানক গরমিল হতে লাগল যে আজ, এই দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকা চোরাবালির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা আর্ত চিৎকারের শক্তিটুকুও হারিয়েছেন, পরস্পরকে ফিসফিস করে বলছেন: কোনও প্রশ্ন নয়, নো কোয়েশ্চেন। পাছে মুখ খুললেই ভোট কমে যায়। সংখ্যাগুরুর ভোট। ব্যতিক্রম একেবারে নেই, তা বলা যাবে না। কিন্তু তাঁরা নিতান্ত ব্যতিক্রম, এবং রাজনীতির ময়দানে আপাতত অন্ত্যেবাসী।
এই পরিণতির জন্যে সঙ্ঘ পরিবারের সন্তান দলকে দায়ী করে কোনও লাভ নেই, তাঁরা মন দিয়ে তাঁদের কাজ করছেন। দায় আমাদের লিবারাল সেকিউলার রাজনীতির, দায় সেই রাজনীতির ধারক এবং তার অনুগামী নাগরিক সমাজেরও। এ আমার এ তোমার পাপ। পাপ একটা নয়। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সংখ্যালঘুদের একটু তফাতে রাখার পাপ, তাঁদের বসতে দেওয়ার আগে জাজিমটা একটু গুটিয়ে নেওয়ার পাপ। সংখ্যালঘুকে ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করার পাপ। সেই ভোটব্যাঙ্কেরও সদ্ব্যবহার না করে অপব্যবহারের পাপ— সংখ্যালঘু মানুষের সামগ্রিক উন্নতির দিকে নজর না দিয়ে ধর্মগুরু বা গোষ্ঠীপতিদের তুষ্ট করে তাঁদের মাধ্যমে নির্বাচনী ফসল তোলার মতলব কেবল গণতন্ত্রের অপব্যবহার নয়, অনৈতিক অপমানও। এই সব পাপের দায়ভাগ নেহরুর উত্তরসূরিদের সঙ্গে সঙ্গে অন্য নানা দলেরও। এমনকি বামপন্থীরাও তা অস্বীকার করতে পারেন না— রাজেন্দ্র সাচারের রিপোর্টে বামফ্রন্ট-শাসিত পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের দুরবস্থার ছবি কেবল স্পষ্ট নয়, দগদগে। আজ যে সঙ্ঘ পরিবারের সংখ্যাগুরুবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদকে অনেকেই চাইলেও খুব গুরুত্ব দিতে পারছেন না, তার পিছনে এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস গৌরবের নয়।
কিন্তু এ সবই ব্যাধির লক্ষণ। আসল ব্যাধি আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়ে। ভারতীয় গণতন্ত্রের ত্রুটি ও সমস্যা নিয়ে অনন্ত আলোচনা হয়েছে, হবেও। কিন্তু এখানে একটা কথাই বিশেষ ভাবে বলা দরকার: আমাদের গণতন্ত্র সংখ্যালঘুকে তার প্রাপ্য স্বক্ষমতা এবং মর্যাদা দেওয়ার মৌলিক দায়িত্ব পালন করেনি। ধর্ম, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি— সমস্ত ধরনের সংখ্যালঘুকে সে আত্মসাৎ করতে চেয়েছে। এ অপরাধ কেবল অনুদার সংখ্যাগুরুবাদীদের নয়, লিবারাল শিবিরেও ব্যাধির সংক্রমণ প্রবল।
এই বিপদ সম্পর্কে নেহরুর ধারণা স্পষ্ট ছিল। এবং, স্বাধীনতার পরে যত দিন গেছে, সেই ধারণা ক্রমশ আরও স্পষ্ট হয়েছে। সাতচল্লিশের প্রথম চিঠিতে তিনি সংখ্যালঘুর স্বার্থরক্ষার পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছিলেন তা ছিল প্রধানত বাস্তববুদ্ধির যুক্তি। যেমন, ভারতে বহু সংখ্যালঘুর বাস, তাঁরা তো অন্য কোথাও চলে যাবেন না, তাই তাঁদের ভাল থাকা, ভাল রাখা সকলের স্বার্থেই জরুরি। এবং, সংখ্যালঘু যদি নিরাপত্তা ও মর্যাদা না পায়, তা হলে বিশ্বের কাছে ভারতের দুর্নাম হবে, ভুলে গেলে চলবে না যে ‘ভারত এখন আন্তর্জাতিক নজরদারিতে আছে।’ নেহরুর সামনে তখন সদ্য-স্বাধীন দেশে সুস্থিতি আনার এবং রাখার দায় সবচেয়ে প্রবল, তাই এই বাস্তবতার দাবিই প্রধান হয়ে উঠেছিল।
তার পর বেলা গড়াল, সংবিধান এল, নির্বাচন হল, সংসদ বসল, নেহরু দেখতে দেখতে স্বাধীন দেশের কার্যত অবিসংবাদিত নায়ক হয়ে উঠলেন। এবং অন্য নানা বিষয়ের মতোই সংখ্যালঘু প্রশ্নেও তাঁর আদর্শগত অবস্থানের ঘোষণা উত্তরোত্তর প্রবল ও প্রত্যয়ী হয়ে উঠল। ১৯৫০-এর ১ মার্চ তিনি মুখ্যমন্ত্রীদের লিখলেন, আমাদের এমন একটা দেশ তৈরি করতে হবে যাকে ‘সমস্ত সংখ্যালঘু মানুষ সম্পূর্ণ নিজের বলে ভাবতে পারেন।’ কিছু দিন পরে, ২ জুলাই, জানালেন তিনি, ‘অন্য সব কিছু ওপরে সংখ্যালঘুদের মনের জোর বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে আমাদের।’’ অর্থাৎ, সংখ্যালঘুর স্বার্থ কতটা ভাল ভাবে, কতখানি যত্নের সঙ্গে সুরক্ষিত রাখতে পারি আমরা, তার ওপর তৈরি হবে ভারতীয় গণতন্ত্রের নৈতিক ভিত।
তিন বছর পরে, ১৯৫৩’র ২০ সেপ্টেম্বর, প্রধানমন্ত্রীর কলমে গভীর উদ্বেগ: ‘‘আমার মনে হয় নানা দিক থেকেই ভারতে সংখ্যালঘুদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে।’’ এই আশঙ্কার একটা বড় কারণ, বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব কমছে, সেটা সামাজিক ভারসাম্যের পক্ষে ভাল নয়। তাঁর বক্তব্য, ‘দেশের প্রতিটি গোষ্ঠী এবং ব্যক্তির মনে একটা অংশীদারির বোধ জাগ্রত করতে হবে, যাতে সবাই মনে করেন তাঁরা সমস্ত সুযোগসুবিধার ভাগ পাচ্ছেন। তবেই যথাযথ মানসিকতার উন্মেষ ঘটতে পারে।’ এবং তার পরেই নেহরু লিখছেন, ‘আমি মনে করি, অন্য কাউকে অনুগত (লয়াল) হতে উপদেশ দেওয়া একেবারেই ঠিক কাজ নয়, যদি ‘আনুগত্য’ বলতে এটাই বোঝানো হয় যে, অন্যদেরও আমাদের তালে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।’
এটাই যথার্থ গণতান্ত্রিকতার মর্মকথা। নেহরু তাঁর রাষ্ট্রচালনায় নিজে এই নীতি কত দূর প্রয়োগ করেছেন, সে তর্ক সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা ও আত্মমর্যাদার অধিকারকে স্বীকার করে, সম্মান করেই গণতন্ত্রের সাধনা সম্ভব— দেশের প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে এই বুনিয়াদি সত্যের সুস্পষ্ট ঘোষণা, কেবল ঘোষণা হিসেবেই, কতটা মূল্যবান, ২০১৯ সালের ভারতে বসে সে কথা মর্মে মর্মে বুঝতে পারি। এবং জানি, ২০১৯ আকাশ থেকে পড়েনি। সংখ্যালঘুর প্রতি আপন নৈতিক দায় স্বীকার না করলে এবং তার ব্যবহারিক দায়িত্ব পালন না করলে গণতন্ত্র সার্থক হতে পারে না— এই গোড়ার কথাটা এ দেশের উদার ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধ্বজাধারীরা যথেষ্ট জোরের সঙ্গে বলেননি। বলার দরকার ছিল। নেহরু অন্তত বলেছিলেন।
নেহরুর চিঠিগুলি থেকে কিছু অংশ বেছে নিয়ে একটি চমৎকার সঙ্কলন সম্পাদনা করেছিলেন মাধব খোসলা। লেটারস ফর আ নেশন (পেঙ্গুইন) নামে সে বই প্রকাশিত হয় নেহরুর ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে। (সঙ্গের ছবি বইটির প্রচ্ছদ থেকে) সেটা ২০১৪। সেই বছরই নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy