এক পা পিছাইল কেন্দ্রীয় সরকার। খসড়া জাতীয় শিক্ষা বিলের বয়ান হইতে হিন্দি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করিবার প্রস্তাবটি সরাইয়া লইল। লক্ষণীয়, যে দুই মন্ত্রী টুইট করিয়া আশ্বস্ত করিয়াছেন যে হিন্দিকে জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইতেছে না, তাঁহাদের নাম নির্মলা সীতারামন ও সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর। জন্মসূত্রে দুই জনই তামিল, এবং টুইটটি তাঁহারা ইংরাজির পাশাপাশি তামিলেও করিয়াছেন। শুক্রবার খসড়াটি প্রকাশিত হওয়া ইস্তক তামিলনাড়ুতে যে প্রতিবাদ আরম্ভ হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তটি দৃশ্যত তাহারই প্রতিক্রিয়া। সে রাজ্যে ‘হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’ রাজনৈতিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে নাই। ডিএমকে, কংগ্রেস, বামপন্থী দলসমূহ এবং কমল হাসনের মক্কল নিধি মইয়ম যেমন প্রতিবাদ করিয়াছে, এনডিএ-র শরিক এআইডিএমকে-ও জানাইয়াছে যে তাঁহাদের রাজ্য দ্বিভাষা নীতি হইতে সরিতেছে না। সেই রাজ্যের নাগরিক সমাজও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাইয়াছে। সামান্য বিলম্বে হইলেও কর্নাটকেও প্রতিবাদ তীব্র হইয়াছে। এই ছবিগুলির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গকে রাখিলে সংশয় হইতে পারে, এই রাজ্য বুঝি হিন্দির আগ্রাসনের আওতার বাহিরেই ছিল। বিশেষত এই রাজ্যের নাগরিক সমাজ। বঙ্গবাসী চিরকালই উদারতার গর্ব করিয়া থাকে। পূর্বে তাহারা ইংরাজিনবিশ ছিল, সম্প্রতি হিন্দিতে তাহার প্রীতি প্রবল। পরস্পরের সহিত হিন্দিতে বাতচিত করিতেও বাঙালির ইদানীং তুমুল উৎসাহ। ইংরাজি-মাধ্যম স্কুলে পাঠরত সন্তানের দ্বিতীয় ভাষা হিসাবেও বহু অভিভাবক ইদানীং হিন্দি বাছিতেছেন, ‘সর্বভারতীয়’ হইবার অত্যুৎসাহে। তামিলনাড়ুর উত্তাল প্রতিবাদের পাশাপাশি বঙ্গের আত্মসমর্পণ দেখিলে আশঙ্কা হয়, এই রাজ্যে বুঝি হিন্দি আর ‘চাপাইয়া’ দিতেও হইবে না— রাজ্যবাসী তাহাকে স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া লইবে। আত্মপরিচয় ভুলিতে এ হেন ব্যাকুলতা এখন বাঙালির অভিজ্ঞান।
প্রশ্নটি হিন্দি-বিরোধিতার নহে। মাতৃভাষা ও ইংরাজি শিখিবার পরে কোনও ছাত্র যদি তৃতীয় ভাষা হিসাবে হিন্দি শিখিতে চাহে, তাহাতে আপত্তি নাই। কিন্তু, যদি অনিচ্ছুকদেরও হিন্দি শিখিতে বাধ্য করা হয়, তাহাতে আপত্তি সঙ্গত এবং জরুরি। কারণ, ভারতের ২৪টি স্বীকৃত ভাষার একটি হইলেও হিন্দি অন্য ২৩টি ভাষার তুল্য নহে। তাহার সহিত সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি। আজ নহে, গোটা ভারতের স্কন্ধে হিন্দি চাপাইয়া দেওয়ার চেষ্টা দেশ স্বাধীন হওয়া ইস্তক চলিতেছে। দক্ষিণ ভারত সমানে তাহা প্রতিরোধ করিয়াছে, বাংলা ক্রমে আত্মসমর্পণের রাস্তায় হাঁটিয়াছে। বর্তমান শাসকদের আমলে এই আধিপত্যবাদের তাৎপর্য প্রবলতর, কারণ ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর রাজনৈতিক সমীকরণটি তাঁহাদের কর্মসূচির অঙ্গ। বিদ্যালয় স্তরে হিন্দির পঠনপাঠন বাধ্যতামূলক হিসাবে মানিয়া লওয়ার অর্থ, ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে অস্বীকার করা— উত্তর ভারতের, হিন্দিভাষী অঞ্চলের সংস্কৃতিকেই ভারতের একমাত্র সংস্কৃতি হিসাবে মানিয়া লওয়া। এই আধিপত্যেরই অন্যতর প্রকাশ ঘটে খাদ্যাভ্যাসের প্রশ্নে, ধর্মাচরণের প্রশ্নে। অর্থাৎ, বাধ্যতামূলক হিন্দির প্রশ্নটি আদৌ বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের নহে, প্রশ্ন দেশের রাজনীতির। ভারত নামক ‘নেশন’টির সংজ্ঞার। ভারতের গ্রহণশীল, উদারপন্থী, বহুত্ববাদী চরিত্রটিকে রক্ষা করিবার যে লড়াই, বাধ্যতামূলক হিন্দির বিরুদ্ধে লড়াই তাহারই অন্তর্গত। তামিলনাড়ুর বিক্ষোভ দেখাইয়া দিয়াছে, যথাযথ প্রতিরোধ হইলে এই আগ্রাসন রুখিয়া দেওয়া যায়। অন্তত সাময়িক ভাবে হইলেও কেন্দ্রীয় সরকার পিছাইতে বাধ্য হইয়াছে। সেই উদাহরণ হইতে বাঙালি শিখিবে, তেমন ভরসা অবশ্য কম। কারণ, সর্বভারতীয় বা আন্তর্জাতিক পরিচিতির সহিত যে বাঙালিসত্তার বিরোধ নাই— সেই পরিচিতি যে লজ্জার নহে, গর্বের— বাঙালি সযত্ন প্রয়াসে কথাটি ভুলিতে সমর্থ হইয়াছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy