বিস্মৃত: আলামোহন দাশের প্রতিকৃতি, দাশনগর। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স
আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে, ১৮৭৬ সালের পয়লা অগস্ট, আদালতে সাক্ষী দিতে গিয়ে বিদ্যাসাগর বলছেন, “আমার নাম ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা বিদ্যাসাগর। আমি স্বর্গীয় ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র। নিবাস কলিকাতা, বয়স ৫৬ বৎসর। লেখক ব্যবসায়ী। আমি কিছুদিন পূর্বে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলাম। আমি বহু সংস্কৃত ও বাংলা পুস্তক লিখিয়াছি।” হ্যাঁ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজেকে ব্যবসায়ী বলেই পরিচয় দিয়েছেন, এতে লজ্জার কিছু ভাবেননি। তিনি ছিলেন এক জন সফল ব্যবসায়ী, সমাজ সংস্কারক, দয়ার সাগর। ১৮৫৮-তে যখন মাসে পাঁচশো টাকার চাকরি ছেড়ে দিলেন, তখন বিদ্যাসাগরের আসল কর্মজীবনের সবে শুরু। আরও তিনটি দশক তিনি তাঁর সমাজ সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে বিদ্যালয় স্থাপন আর দানের কর্মধারা সজীব রেখেছেন। এই কর্মজীবনের একটি বড় কাজ বিধবাবিবাহের আন্দোলনকে চালিয়ে যাওয়া। এই বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠানগুলির জন্য বিদ্যাসাগরের অনেক অর্থব্যয় হত। এই ব্যয়বহুল কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই বিদ্যাসাগর চালিয়েছেন তাঁর পুস্তক ব্যবসায়ের আয়ে।
ব্যবসায়ী পরিচয়টি গত কয়েক দশকের বাঙালির কাছে একটি ‘অসংস্কৃত’ পরিচয়। যথেষ্ট টাকা করাটাও খুব একটা ভাল লক্ষণ নয়। সত্যজিৎ রায়ের নায়ক ছবিতে শুরুতেই আছে এক অবাঙালি ব্যবসায়ীর প্রতি ব্যঙ্গাত্মক উপেক্ষা। পরে দেখা যাচ্ছে, চলচ্চিত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত নায়ক স্বপ্নে দেখছেন তিনি টাকার পাহাড়ে ডুবে যাচ্ছেন এবং এই টাকার জন্য হারাচ্ছেন তাঁর প্রিয় সঙ্গীদের। নায়ক কোনও অসৎ উপায়ে টাকা রোজগার করেননি, কিন্তু এত আয় করাটাই যেন অন্যায়। প্রায় একই সময়ের ছবি মৃণাল সেনের আকাশকুসুম। একটি নিম্নবিত্ত ঘরের যুবকের ব্যবসা করে বড় হওয়ার চেষ্টা যে আকাশকুসুম, তার বৃত্তান্ত। যুবকের চাকুরে সচ্ছল বন্ধু বলছে, চিঁড়েমুড়ি খেয়ে আলামোহন দাশ হবি, সে যুগ আর নেই। বিগ বিজ়নেস সব খেয়ে নিচ্ছে। এ রকম উদাহরণ আরও অনেক। অবশ্য যাদবপুর বা শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের এক জনও সম্ভবত জানে না হাওড়ায় বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের গর্ব আলামোহন দাশের নাম, বার বার ব্যর্থ হয়েও তাঁর শিল্পপতি হওয়ার স্বপ্ন সফল করার কাহিনি।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি যখন বাঙালি যুবক এই সব ব্যবসা-শিল্প-বিরোধী মহৎ চিন্তায় ব্যস্ত হতে শুরু করেছে, তখন মুম্বইয়ে এক দরিদ্র ইস্কুল মাস্টারের ছেলে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করে আকাশকুসুম দেখছিলেন, তাঁর নাম ধীরুভাই অম্বানী। বাকিটা ইতিহাস। বাংলার বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসারের অন্যতম প্রধান বিড়লা পরিবার, তাঁদের সহায়তায় কলকাতায় বিজ্ঞান মিউজ়িয়াম, প্ল্যানেটারিয়াম, কলা প্রতিষ্ঠান করার পরও কলকাতায় কোনও রাজপথ, উদ্যান বা সেতু বিড়লাদের নামাঙ্কিত হয়ে উঠতে পারেনি। কলকাতার কেন্দ্রে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন লেনিন, ঐতিহ্যবাহী ধর্মতলার নামটাও তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে। তাই দু’শো বছর পূর্তিতে বিদ্যাসাগর নিয়ে আলোচনার ঢেউ উঠলেও ব্যবসায়ী উদ্যোগপতি বিদ্যাসাগর আলোচিত হলেন না।
এ দিকে বাংলায় নবজাগরণের যুগ এসেছিল বাঙালি চিন্তাবিদ, সংস্কারকদের সঙ্গে বাঙালি ব্যবসায়ী ও উদ্যোগপতিদের সমন্বয়ের ফলেই। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাংলায় এক নতুন যুগের শুরু, যাকে রামমোহন রায় স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন ‘ঈশ্বরের দান’ (ডিভাইন প্রভিডেন্স)। এই যুগ পরিবর্তনের প্রথম ধাপ ষোলো বছর পর মুর্শিদাবাদকে হটিয়ে ১৭৭৩ সালে কলকাতা হল বাংলার রাজধানী। ১৭৭৪ সালে জন্ম রামমোহন রায়ের, যিনি বাংলা-সহ ভারতের নবজাগরণের সূচনা করবেন। নবজাগরণের দু’টি দিক: বাণিজ্য ও বিদ্যার অবাধ বিকাশ। নবজাগরণের এই দিকটি সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে বিনয় ঘোষের লেখায়, “বণিকশ্রেণী ও বিদ্বানশ্রেণীর এই আনুরূপ্য উনিশ শতকের বাংলার সমাজ-জীবনেও পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। নবযুগের বাঙালী বণিকশ্রেণীর মধ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, রামদুলাল দে প্রমুখ অনেক বাঙালী যাঁরা অবাধ বাণিজ্যের পথে দুঃসাহসিক অভিযান করেছিলেন, সদাগরী স্বার্থে নিমগ্ন হয়ে তাঁরা সাংস্কৃতিক কর্তব্য ভোলেননি।”
ষাটের দশক থেকে বামপন্থী আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গকে শিল্পের মৃত্যু-উপত্যকায় রূপান্তরিত করল। সেই সময় যাদবপুর অঞ্চলে বিশ্বকর্মা পূজার রমরমা ছিল দুর্গা পূজার মতো। লোকেরা ভিড় করে বিশ্বকর্মা ঠাকুর দেখতে যেত সুলেখা, বেঙ্গল ল্যাম্প, কৃষ্ণা গ্লাস, অন্নপূর্ণা গ্লাস, উষা কোম্পানি, ন্যাশনাল ইনস্ট্রুমেন্ট কারখানাতে আর যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। এই সব কারখানা এখন স্রেফ কয়েকটি বাসস্টপের নাম হয়ে এক আধিভৌতিক অনুভূতি ছড়িয়ে রাখে। শোনা যায়, যাদবপুরের এক বাম ছাত্র নেতাকে কর্তৃপক্ষ তার অভিভাবককে নিয়ে আসতে বলায় সে উষা কোম্পানির শ্রমিকদের মিছিলকে কলেজে ঢুকিয়ে দেয়, বলে এঁরাই আমার অভিভাবক। কয়েক হাজার শ্রমিকের উষা কোম্পানি লাল ঝান্ডার আন্দোলনে উঠে গেল, এখন সেখানে গড়া বিলাসী আবাসনের বহুতলে বসে বিপ্লবী নিবন্ধ লেখা হয়। যাদবপুরের প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্রদের শিক্ষাপর্বে শিল্প গড়ার উস্কানি কেউ কখনও দেয়নি।
সেটা ভাল বুঝেছিলাম গত দু’-দশকে দুর্গাপুরের শিল্পাঞ্চলের পরিবর্তন দেখে। আশি নব্বইয়ের দশকে দুর্গাপুর যেতাম, হাওড়া স্টেশন থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ট্রেনে চেপে। দুর্গাপুর স্টেশনের প্রবেশদ্বারের দু’পাশে আঁকা ছিল মার্ক্স ও লেনিনের দু’টি বিশাল ছবি আর সরকারি দুর্গাপুর কেমিক্যালসে ৩৪টির জায়গায় তৈরি হত স্রেফ ৪টি দ্রব্য। ধুঁকত ডিপিএল, ধীরে ধীরে এমএএমসি-র কারখানা আর কলোনি হয়ে গেল ম্যালেরিয়ায় পরিত্যক্ত গ্রাম। নতুন শিল্প নেই, শুধু আছে লাল পতাকা ও দেওয়ালে পোস্টার। নতুন শতাব্দীতে এল লোহা তৈরির নতুন প্রযুক্তি, স্পঞ্জ আয়রন। একের পর এক নতুন কারখানা, স্পঞ্জ আয়রনের সাহায্যে ইস্পাতের সামগ্রী তৈরির কারখানা। দুর্গাপুর পাল্টে গেল, আবার দুর্গাপুর সজীব। দূষণ কিছু হল বটে, কিন্তু পরিবেশবাদী সংগঠনরা সাক্ষী, স্থানীয় মানুষেরা বললেন, দূষণ কমান, তবে কারখানা বন্ধ করবেন না, আমরা কাজ পেয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের এত বড় শিল্প পুনরুজ্জীবনে মাত্র একটি বাঙালি শিল্পপতি পরিবার পেয়েছিলাম, তাঁরাও বছর কয়েক বাদে তাঁদের কারখানাগুলি বিক্রি করে দিয়েছেন। এই সব কারখানার মালিকেরা পশ্চিমবঙ্গেরই বাসিন্দা, কিন্তু বাঙালি নন।
বাঙালি পড়াশোনা করে ডিগ্রি আনে, কবিতা লেখে, কলেজে পড়ায়, সংস্কৃতি চর্চা করে, কিন্তু শিল্প বা ব্যবসা করে না। যাঁরা কিছু করেন, তাঁদের সমাজে পুজোর চাঁদা চাওয়া ছাড়া কেউ পোঁছে না। বুদ্ধিজীবী তালিকায় তৃতীয় শ্রেণির সিরিয়ালের অভিনেতা পাওয়া যেতে পারে, ব্যবসায়ী কখনওই নয়। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদদেরও প্রায় একই অবস্থা। একেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন ‘মরণোন্মুখ বাঙালী’। আলামোহন দাশ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মতোই আর এক বিদ্বান শিল্পপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কী বলেছেন দেখে নেওয়া যাক: “আমার বিশ্বাস আমার দেশবাসীগণ আলামোহন দাশের নাম শুনিয়াছেন। শুধু তাঁহার অসাধারণ কার্য্যকুশলতা দেখিবার সুযোগ পান নাই। যে লোকটি প্রথম জীবনে ৭-৮ বৎসর কলিকাতার রাস্তায় রাস্তায় খৈ-মুড়ি বিক্রয় করিয়া কর্মজীবন শুরু করিয়াছিল সেই আলামোহন ও এই আলামোহন দাশ যে একই লোক এ-কথা চোখে দেখিলেও বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না। কয়েকটি মাত্র অক্লান্ত কর্মী সহযোগীর সহিত দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া আলামোহন দাশ যে সব বিরাট শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিয়াছেন তাহা দেখিয়া মনে হয় আমি এক স্বপ্নরাজ্যে আসিয়াছি। আলামোহন দাশের জুটমিল ও তিনটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে দেখিয়াছি। এগুলি শুধু কারখানা নহে, মরণোন্মুখ বাঙালীর তীর্থক্ষেত্র।”
পশ্চিমবঙ্গে এখন পরিবর্তনের কথা চলছে, তাতে আবার সিঙ্গুর বা নয়াচরের ভুল সংশোধনের কথা বলে শিল্প ফেরানোর কথাও উঠে এসেছে। খুবই ভাল। কিন্তু ‘মরণোন্মুখ বাঙালী’কে শিল্পোদ্যোগী, বাণিজ্যমুখী করতে গেলে শুধু পরিবর্তন নয়, চাই আর একটি নবজাগরণ।
পার্ক স্ট্রিটের নাম বদল করা হয়েছে, আর এক বার তা বদল করা হোক প্রযুক্তিবিদ সাধন দত্তের নামে, যিনি এই রাস্তায় দশতলা অফিস করে সম্পূর্ণ বাঙালি মেধা সম্বল করে আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অবশ্য কোনও বুদ্ধিজীবী প্রশ্ন করে ফেলতে পারেন, “সাধন হু?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy