Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

শিক্ষার ধর্ম

সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়ায় হিন্দি চাপাইবার চেষ্টা লইয়া শোরগোল উঠিয়াছিল।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

রাষ্ট্র ও জাতির সকল ক্রিয়াকর্মের চালিকাশক্তি হইল সংবিধান। তাহার প্রস্তাবনায় মুদ্রিত প্রতিটি ধারণার কার্যকালে যথার্থ রূপায়ণেই দেশের অগ্রসরতার প্রমাণ। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রকে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে গড়িয়া তুলিবার শপথ নেওয়া হইয়াছে। অবশ্য, শপথ পথ দেখাইলেও গন্তব্য অদ্যাপি সুদূর। বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে। সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়ায় হিন্দি চাপাইবার চেষ্টা লইয়া শোরগোল উঠিয়াছিল। তাহা থামিয়াছে, অপর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লইয়া তর্ক বা আলোচনা হইতে পারিত তাহা উপেক্ষিতই রহিয়া গিয়াছে। প্রায় পাঁচশত পৃষ্ঠার শিক্ষানীতিতে কোথাও ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দ দুইটির উল্লেখ নাই। এই অনুপস্থিতি ইচ্ছাকৃত কি না জানা নাই, তবে উদ্বেগজনক বটে।

উদ্বেগ কিসে? কারণ শিক্ষানীতিই নির্ধারণ করিয়া দেয় শিক্ষার সার্বিক চেহারা কেমন দাঁড়াইবে, স্কুল ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যক্রম কী রূপে ঠিক হইবে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও নিয়োগে কোন নীতি অবলম্বন করিতে হইবে। এক বার এই সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইয়া গেলে সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চলিবে সেই মতে, সেই পথে। এই জন্যই শিক্ষাক্ষেত্রে সংবিধান-উল্লিখিত ধর্মনিরপেক্ষতার সবিশেষ গুরুত্ব রহিয়া যায়। ১৯৮৬ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি বা ২০০৫ ও ২০০৯ সালের জাতীয় পাঠ্যক্রম কাঠামোতে সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল, সমস্ত শিক্ষাপ্রকল্প হইবে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের সুদৃঢ় অনুসারী; গণতন্ত্রের পাশাপাশি সাম্য, ন্যায়, স্বাধীনতা, মানুষের মর্যাদা ও অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি শিক্ষার দায়বদ্ধতা থাকিবে। বর্তমান শিক্ষানীতিতে পূর্বের সমস্ত কিছুই আছে, সংবিধান-স্বীকৃত ধারণাগুলি যাহাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশে মান্যতা পায় তাহাতে জোরও দেওয়া হইয়াছে। বাদ গিয়াছে কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা। সৌভ্রাতৃত্ব ও বহুত্ববাদের ন্যায় ধারণাগুলি ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যতীত প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে কি? পাশ্চাত্যে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করিয়া দেওয়া। ভারতে তাহা নহে। এইখানে ধর্মনিরপেক্ষ বলিতে বুঝায় সকল ধর্মের মানুষের সমান পরিচর্যা। এই পরিচর্যার ভার রাষ্ট্রের। সেই রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত শিক্ষানীতি যদি শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রমে ভারতের বিচিত্র ও বহুবিধ ধর্ম-ঐতিহ্যকে সমান স্থান না দিয়া ধর্মবিশেষের প্রতি পক্ষপাত দেখায়, তাহা হইলে পড়ুয়াদের সুকুমার মনও উগ্র একদেশদর্শিতার দিকে ঢলিতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হইলে সেই শিক্ষার্থী ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক হইবে, নিশ্চয়তা কোথায়?

সমস্যা শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের নহে। শিক্ষার নীতি নির্ধারণ হইতেছে ক্ষমতার যে পীঠ হইতে, তাহারও। রাজতন্ত্রের কালে রাজার ভাষাই প্রজার ভাষা হইত, রাজার ধর্মেই রাজ্যবাসীও দীক্ষা লইত। যত না ভক্তিতে, তাহারও অধিক ভয়ে। নির্বাচনে জয়ী হইয়া নরেন্দ্র মোদী তাঁহার বিজয় ভাষণের মঞ্চ হইতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ব্যঙ্গ করিয়া গণতন্ত্রকে সাধুবাদ জানাইয়াছিলেন। উচ্ছ্বাসের আবহে ভারতীয় গণতন্ত্রের বহুস্বর, বহুধর্মী রূপটি চাপা পড়িয়াছিল। অতঃপর সংবিধান-স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার কথা কেহ স্মরণ করাইয়া দিতে উদ্যত হইলেই খাঁড়া নামিয়া আসিয়াছে। বিভেদ-বিদ্বেষের আগুনে রাষ্ট্র পুড়িলে বিদ্যালয়ও বাদ যাইবে কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Education National Education Policy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy