সূচনা: অযোধ্যায় শ্রীরাম জন্মভূমি মন্দিরের ভূমিপূজা করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ৫ অগস্ট, ২০২০। ছবি: পিটিআই।
তেরো দিনের সরকারের শেষবেলা। আস্থা ভোটের বিতর্কে অটলবিহারী বাজপেয়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিছু ক্ষণ পরে তিনি নিজেই রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিতে যাওয়ার কথা জানাবেন। তার আগে আচমকাই বাজপেয়ীর বক্তৃতায় রামমন্দিরের প্রসঙ্গ উঠে এল।
লোকসভা। ১৯৯৬ সালের ২৮ মে।
সেই প্রথম বিজেপির কোনও নেতা প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসেছেন। কিন্তু সরকারের মুখে বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের ‘মূল কর্মসূচি’— রামমন্দির, ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা নেই। আস্থা ভোটের বিতর্কে তা নিয়ে অনেকেই কটাক্ষ করেছিলেন। বাজপেয়ী তারই জবাব দিলেন।
কী বলেছিলেন সে দিন বাজপেয়ী? প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী প্রথমে রসিকতার সুরে বলেছিলেন, ‘এমন ভাবে রামমন্দির, ৩৭০ রদ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির উল্লেখ নেই বলে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যেন এতে খুব দুঃখ হয়েছে। কিন্তু এ সবের জন্যই তো এত দিন আমাদের সমালোচনা হয়েছে। রামমন্দির তৈরি করতে চাই বলে আমাদের দোষী ঠাওরানো হয়েছে। ৩৭০ রদ করতে চাই বলে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, দেশের ঐক্য কী ভাবে রক্ষা করব! সংবিধানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা বললেই অভিযোগ উঠেছে, দেশের ঐক্য নষ্ট করছি।’
কিন্তু বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের ‘মূল কর্মসূচি’ থেকে যে তাঁরা সরছেন না, তা স্পষ্ট করে বাজপেয়ী জানিয়ে দেন, এই সরকারের কর্মসূচিতে রামমন্দির, ৩৭০, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নেই। কারণ বিজেপির কাছে এখন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। বাম নেতারা ‘ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে’ বলে হইহই করলেন। বাজপেয়ী বললেন, এর মধ্যে লুকোছাপার বিষয়ই নেই। বিজেপি লোকসভায় বৃহত্তম দল হলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। জোট বেঁধে চলতে হবে বুঝেই বিতর্কিত বিষয়ের উল্লেখ করা হয়নি।
১৯৯৬-এর ভোটে বিজেপি লোকসভায় মাত্র ১৬১টি আসন জিতেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ‘ম্যাজিক সংখ্যা’ ২৭২-এর অনেক কম। অকালি দলের মতো শরিককে নিয়েও বাজপেয়ী সেই জাদু-সংখ্যা ছুঁতে পারেননি। তাঁকে লোকসভা থেকেই রাষ্ট্রপতির কাছে ইস্তফা দিতে যেতে হয়েছিল।
২৩ বছর পরে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি ৩০৩টি আসনে জিতে এসেছে। বিজেপি এখন একাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, শরিকদের ছাড়াই।
অতএব? ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ হয়ে গিয়েছে। রামমন্দিরের শিলান্যাস হয়ে গেল। এ বার নিশ্চিত ভাবেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আসবে। এমনটাই বাজপেয়ী ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। বাজপেয়ী লোকসভায় দাঁড়িয়ে লুকোছাপা করেননি। এখন নরেন্দ্র মোদীও লুকোছাপা করছেন না।
অযোধ্যায় ৫ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী রামমন্দিরের শিলান্যাস করলেন। দশ দিনের মাথায় লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন। অযোধ্যায় দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে রামমন্দির আন্দোলনের তুলনা করে দু’টিকেই একই পঙ্ক্তিতে বসালেন। অযোধ্যায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী রাম-রাজ্যের স্বপ্ন দেখিয়ে বলেছিলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের মতোই রামমন্দির আন্দোলনে দেশের বহু মানুষ দীর্ঘ সময় আত্মত্যাগ করেছেন। রামমন্দিরের শিলান্যাস সেই আত্মত্যাগেরই পরিণতি। দেশের উন্নয়ন-যজ্ঞে অনেককেই আত্মত্যাগ করতে হবে। সেই আত্মত্যাগেই ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ হবে।
দশ দিনের ব্যবধানে দুই বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেশের মানুষের যেন এক নতুন সম্পর্ক তৈরি করে ফেলতে চাইলেন। দেশের মানুষ আর নাগরিক বা ভোটার নন। কাঁধ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুল, দীর্ঘ শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত প্রধানমন্ত্রী যেন কোনও রাজর্ষি। তিনি অভিভাবক। দেশের নাগরিক তাঁর সন্তানসম। সন্তানদের কিসে মঙ্গল, তা তিনিই ঠিক করেন। তাঁদের স্বার্থে কখনও আচমকা নোট বাতিল, কখনও আচমকা লকডাউনের মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তার জন্য কষ্ট, হেনস্থা হতে পারে। শ্রমিকদের রুটিরুজি হারিয়ে পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরতে হতে পারে। ব্যবসা মার খেতে পারে। কিন্তু দেশের স্বার্থে সেই ‘আত্মত্যাগ’ মেনে নিতে হবে।
সঙ্ঘ পরিবারের রামমন্দির-৩৭০ রদ-অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মতো কর্মসূচির সঙ্গে উন্নয়ন-যজ্ঞের এই মিশেলও অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেই শুরু। ১৯৯৬-এ ১৩ দিনের সরকারে পারেননি। কিন্তু ১৯৯৮-তে ফের ক্ষমতায় এসে বাজপেয়ী সোনালি চতুর্ভুজের পরিকল্পনা করেছিলেন। মোদী লালকেল্লা থেকে বাজপেয়ীর সেই কর্মসূচিকে শ্রদ্ধা জানিয়েই সড়ক-রেল-বন্দর-বিমানবন্দরের মতো সমস্ত যোগাযোগের পরিকাঠামো এক সুতোয় বাঁধতে চাইছেন। দেশ জুড়ে মসৃণ জাতীয় সড়ক তৈরি করে বাজপেয়ী ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’-র স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। এখন ১০০ লক্ষ কোটি টাকার পরিকাঠামোয় ভর করে নরেন্দ্র মোদী শ্রেষ্ঠ ভারতের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের জন্য বাজপেয়ী জমানাতেই পৃথক দফতর খোলা হয়েছিল। এখন মোদী জমানায় হাতে গোনা কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রেখে বাকি সব বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্য ঘোষণা হয়ে গিয়েছে।
একটা সূক্ষ্ম ফারাক অবশ্য রয়েছে। বাজপেয়ী নিজে লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো রামমন্দির আন্দোলনের মুখ হননি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে নিজের হাতে রামমন্দিরের ভূমিপুজো, শিলান্যাস করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভাবনা থেকে ‘গেল, গেল’ রব উঠলেও বিজেপি নেতারা বলছেন, হিন্দু প্রধানমন্ত্রী নিজের ধর্মাচরণ করতেই পারেন। অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে ভেদাভেদ না করলেই হল। সেটাই ধর্মনিরপেক্ষতা। প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা আন্দোলন ও রামমন্দির আন্দোলনের মধ্যে আত্মত্যাগের মিল খুঁজে দিয়েছিলেন। বিজেপি নেতারা বলছেন, মিল ‘স্বাধীনতা’ প্রাপ্তিতেও। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট ব্রিটিশদের গোলামি থেকে মুক্তির দিন। ৫ অগস্ট রামমন্দিরের শিলান্যাস মুসলিম শাসকদের বশ্যতা মেনে নেওয়ার মানসিকতা থেকে হিন্দুদের মুক্তির দিন। রামের জন্মভূমিতে বাবরি মসজিদ ছিল সেই বশ্যতা স্বীকারের নমুনা। মসজিদ ভাঙার পরে সেখানেই মন্দির তৈরি করে তা থেকে মুক্তি মিলল। হিন্দুদের এ এক নবজাগরণ।
এই ‘জাদু-বাস্তবতা’র আড়ালে আসল বাস্তবতা ঢাকা পড়ে যায়। যে বাস্তব বলে, দেশের অর্থনীতির বহর এতটাই শুকিয়ে আসছে, যা ১৯৪৭-এর পরে আর হয়নি। আগে থেকেই ঝিমুনি ধরা অর্থনীতিতে লকডাউনের জেরে লাখো মানুষের রুটিরুজিতে টান পড়েছে। বেকারত্ব বাড়ছে। ৩৭০ রদ করে মোদী সরকারের আশ্বাস ছিল, কাশ্মীর উপত্যকায় শান্তি আসবে। কিন্তু কাশ্মীরে জঙ্গি-হামলা ক্রমশ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠছে। লাদাখে চিনের অনুপ্রবেশ নিয়েও সমাধান কবে মিলবে, উত্তর নেই।
তা হলে ‘রাম-রাজ্য’ কী ভাবে আসবে?
সমালোচকরা বলছেন, রাম-রাজ্য নয়। অযোধ্যা থেকে নরেন্দ্র মোদী আসলে হিন্দু-রাষ্ট্রের পথে যাত্রা শুরু করেছেন। নাগরিকত্ব আইন, ৩৭০ রদ, রামমন্দিরের পরের ধাপ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। বাজপেয়ী যাকে সহজ করে বলতেন, বিয়ে-শাদির সমান আইন। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, দত্তক, উত্তরাধিকারের মতো বিষয়ে সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য একই আইন চালু হবে। মুসলিমদের ক্ষেত্রে শরিয়ত মেনে এ সব বিষয়ে নিয়মকানুন তৈরি হয়েছে। তা আর চলবে না।
সংবিধানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা ছিল ঠিকই। কিন্তু বলা হয়েছিল, দেশে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হলেই এই বিধি চালু হবে। অম্বেডকর বলেছিলেন, রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা থাকলেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হবে, এমন আশঙ্কার কারণ নেই। কারণ তাতে মুসলিম, খ্রিস্টানদের আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু লোকসভায় ৩০৩টি আসন জয়ের পরে বিজেপি নেতৃত্ব মনে করেন, কিছু মানুষের আপত্তি-অসন্তোষ থাকলেও দেশের স্বার্থের জন্য অনেক পদক্ষেপ করতে হয়। তাতে কারও কষ্ট হলেও সেটা দেশের স্বার্থেই ‘আত্মত্যাগ’!
বাজপেয়ী সংসদে বলেছিলেন, ‘দেশের স্বার্থে আমরা যে কাজ শুরু করেছি, তার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম নেব না।’ মোদী বাজপেয়ীর সেই অসমাপ্ত কাজই শেষ করার দিকে এগোচ্ছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy