অসমের মানুষ আগে অসমিয়া, পরে হিন্দু, কিংবা, ভীম আর্মি দিল্লির পথে নেমে লড়তে পারে মুসলিমদের সঙ্গে— এই সব অঙ্ক বোধ হয় নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহের সিলেবাসের বাইরে ছিল। তাই ভারত নামে দেশটার মৌলিক অস্তিত্ব বাঁচানোর দাবিতে আবেগ-থরোথরো এই ছবি বেশ নতুন সমস্যার সামনে ফেলে দিয়েছে দেশের দাবাং সরকারকে।
শুরুটা কিন্তু সেই তিন বছর আগে। লোকে বলে, উত্তরপ্রদেশের গদি চাই যে কোনও মূল্যে, অমন একটা পরিস্থিতিতে কালো টাকা, সন্ত্রাস ইত্যাদি নানান গল্প বানিয়ে সেই যে নোটবন্দির ছাপ্পান্ন ইঞ্চি মায়াজাল তৈরি হল, দেশের অর্থনীতির শেষের শুরু সেই থেকেই। ধীরে ধীরে দেশের গ্রামীণ আর প্রান্তিক অর্থনীতি রক্তশূন্য হয়ে গেল। ছোট আর মাঝারি শিল্প পথে বসল। এক কোটির বেশি মানুষ কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরে এলেন। গড়ে প্রতি দিন ৩৫ জন কৃষক জীবন শেষ করে ফেলতে শুরু করলেন দেশের নানা প্রান্তে। তার পর এল এক আধসিদ্ধ জিএসটি: সেটা খায় না মাথায় মাখে, তা বুঝতে বুঝতেই ভারতীয় শিল্পের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।
ফলে অর্থনীতি আজ যে গতিতে দুই বছর ধরে নীচে নামছে— তার ছায়া এখন সর্বগ্রাসী। তথ্য নিয়ে জারিজুরি করেও ছেঁড়া কাপড়ে সব কা বিকাশের জীর্ণ অবয়ব ঢাকছে না। অনেক আগে জার্মানিতে এক শাসকের গলায় শোনা গিয়েছিল, মানুষকে এমন শোষণ করো যে সে বেঁচে থাকাটাকেই বিকাশ বলে ভাবতে শুরু করে। কী আশ্চর্য সমাপতন!
এই আবহে যখন এল জাতীয় নির্বাচন, তখন দরকার হয়ে পড়ল ছেলে-ভোলানোর ছুতো। কাশ্মীর আর পাকিস্তানের থেকে ভাল মশলা আর কী বা থাকতে পারে। পরের ঘটনা সবারই জানা— সাধারণ মানুষের আর্থিক কষ্ট নিয়ে বেশি মাতামাতি না করে বালাকোট হয়ে লোকসভার পথটাই যে সবচেয়ে মসৃণ, দেশবাসীর বিপুল সমর্থনে তা স্পষ্ট হয়ে গেল।
বর্ধিত গরিষ্ঠতায় বলীয়ান জোড়া-বাহুবলীর সরকার তবুও অর্থনীতির অস্বস্তি কিছুতেই কাটাতে পারছে না। তাই একের পর এক আসছে নজর ঘোরানোর কল। এল ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি, দেশবাসী খুশিতে ডগমগ— কাশ্মীরিরা জাহান্নমে যাক, তাঁদের কথায় কান দেওয়ার কী আছে, কাশ্মীর তো ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই। এ বার নিশ্চিন্তে কাশ্মীরি কন্যাদের বিয়ে করা যাবে, আর ঝিলমের ধারে বাংলো বানানো যাবে। আশি লক্ষ মানুষকে তাই পাঁচ মাস ধরে ঘরে আটকে রেখে উন্নতির বন্যা বইয়ে দেওয়া গিয়েছে।
এ দিকে অসমের এনআরসি দুর্যোগ। ভাবা গিয়েছিল মুসলমান ধরার কল পাওয়া গিয়েছে। কী কাণ্ড, দেখা গেল, মুসলিমের চেয়ে হিন্দু আটকেছে বেশি। ফলে আবার ভোটব্যাঙ্ক যায়-যায় অবস্থা। মুশকিল, সামনে আবার বাংলার ভয়ঙ্কর গুরুতর ভোট পর্ব এল বলে। আর্থিক মন্দা ক্রমশ গ্রাস করছে সব কিছু, আরবান-নকশাল অর্থনীতিবিদ বলছে দেশের আর্থিক অবস্থা আইসিইউ-তে ঢোকার মুখে। এমনকি যে ইতিহাসবিদ ভারতের রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক চালান, তিনিও ব্যাঙ্কগুলোকে সতর্ক করছেন।
ফলে, এখন আবার চাই জাদুকর বরফির ওষুধ— যা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে দেবে ধূম্রজাল। অতএব ঝুলি থেকে বেরোল ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বটিকা’, যা ধর্ম দিয়ে সহজেই বুঝিয়ে দেবে কে আপন কে পর। চেতন ভগত বলছেন, এনআরসি হল জাহাজ থেকে মানুষকে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা, আর সিএএ হল তার আগে বেছে বেছে কিছু মানুষকে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দেওয়া। যে ভোটার কার্ড হাতে ধরে দেশবাসী ভোট দিয়ে সরকার গড়ল, সেই সরকারেরই মন্ত্রিমশাই বলছেন: ভোটার কার্ড, আধার, পাসপোর্ট— এ সব দিয়ে নাগরিক হয় না। মহামন্ত্রী যোগ করছেন: মাথায় টিকি না ফেজ টুপি, সেটাই তো আসল পরিচয়।
কিন্তু মনে হচ্ছে এ বারের হিসেবটা বোধ হয় কোথাও একটু গোলমাল হয়েছে। হিন্দু আর মুসলমানের লড়াই লাগানোই যেখানে যুগ যুগ ধরে সর্বরোগহরা পাঁচন, সেখানে কেমন যেন সব কিছুই বেসুরে বাজতে শুরু করেছে। আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লি থেকে বেঙ্গালুরু। উদয়ন পণ্ডিতদের জেলে ভরে, পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করেও সামাল দিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। দিল্লিতে পোস্টার পড়ছে: ১৯৪৭-এ দেশের যে মুসলিমেরা ‘ইসলামি রাষ্ট্রে’ যেতে চাননি, ২০১৯ সালে তাঁদের কথা ভেবে এ বার হিন্দুদের দায়িত্ব ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ আটকে দেওয়ার।
দেশবাসীর ক্রোধ যখন বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে বইছে, তখন আবার নিশ্চয়ই চাই নতুন ছুতো। সে উত্তরও তো সোজা। পুলওয়ামা-রানাঘাট-তিব্বত-বালাকোট, মাত্র সওয়া ঘণ্টার পথ। এ পথের যে কী জাদু, সে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান বলেই দিয়েছেন দুই দিন আগে: নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পরিস্থিতি যাকে বলে ‘গম্ভীর’, যে কোনও মুহূর্তে তা গম্ভীরতর হয়ে যেতে পারে। তাই, হে মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, সজাগ থাকো! হয়তো কোনও যুদ্ধের চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে ইতিমধ্যেই। কাশ্মীরে ইতিমধ্যেই ইন্টারনেট বন্ধে বিশ্বরেকর্ড হয়ে গিয়েছে, আর একটা কিছু ধামাকা হয়ে গেলেই আরও তিনশো দিন বন্ধ রাখতে কোনও অসুবিধে হবে না। আর সেই সুযোগে চট করে এক দিন মেঘলা আকাশ দেখে, রাডার-কে আব্বুলিশ দেখিয়ে, হরধনু তুলে, ‘জয় শ্রীরাম’ বলে সীমান্তের ও-দিকে নিক্ষেপ করলেই কেল্লা ফতে। ভক্ত ভারতীয়ের আবেগের স্রোতে ভেসে যাবে সিএএ-এনআরসি জাতীয় ছোটখাটো সমস্ত সমস্যা।
আর আকাশে ধ্বজা তুলবে শ্রীরামচন্দ্রের জাতীয় ছাপ-যুক্ত দেবালয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy