চট্টগ্রামের এঁদো পল্লি জোবরাতে ৪২ জনকে ৮৫৬ টাকা ধার দিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন স্বপ্নের সওদাগরি। তখন তিনি মধ্য-ত্রিশ। আজ মধ্য-আশিতেও তাঁর ঝোলায় স্বদেশের জন্য নানা রঙের স্বপ্ন: কখনও ঋণ, কখনও মোবাইল ফোন, কখনও দারিদ্র-মুক্তি, কখনও দিন বদলের হাতছানি। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, মুহাম্মদ ইউনূসের বংশপরম্পরাগত পদবি ‘সওদাগর’। ইউনূস কিংবা তাঁর আট ভাইবোনের কেউই অবশ্য তা লেখেন না। তাতে কী, ইউনূস এই পারিবারিক অভিজ্ঞানটির সার্থক বাহক হয়ে থেকেছেন বরাবর।
নব্বইয়ের দশক থেকেই ইউনূস বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বেশি আলোচিত ‘অরাজনৈতিক’ চরিত্র। আজ যখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান, বাংলাদেশের জনগণও সম্ভবত ভুলে গিয়েছেন যে, ১৯৯৫ সালেই তাঁর নাম তখনকার তদারকি সরকারের প্রধান হিসাবে জোর চর্চায় ছিল। শেষ অবধি তিনি তা হননি, তবে দশ জনের ওই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। সে বারই শেখ হাসিনা প্রথম বারের জন্য নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হন।
জনপরিসরে ইউনূসের দীর্ঘ পরিভ্রমণ যেন এক আলো-আঁধারির নকশি কাঁথা। কেউ বলতে পারেন, বাংলাদেশের জটিল সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির গ্রন্থিমোচনের চেয়েও অনেক গুণ কঠিন কাজ তাঁর সেই যাত্রাপথের স্থানাঙ্ক নির্ণয়। তাঁর নিজের কথাতেই, তিনি বরাবর ‘অরাজনৈতিক’— ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে বাংলাদেশের দারিদ্রকে পাকাপাকি ভাবে বিদায় করাই তাঁর একমাত্র বাসনা। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতি জগতের মাথা যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও দীর্ঘ দিনের— জিয়াউর রহমান থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা জ়িয়া থেকে শেখ হাসিনা, প্রত্যেকের সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক ছিল। ইউনূস বলেছিলেন, ১৯৭৪-এ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও নাকি তাঁর আলোচনা হয়েছিল ‘গ্রাম সরকার’ মডেল নিয়ে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করার কিছু দিন পরে ইউনূস পাড়ি দেন আমেরিকায়। পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করার পর অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপনাও আরম্ভ করেন। তারই মধ্যে জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। আমেরিকায় আরও কয়েক জনের সঙ্গে তৈরি করেন বাংলাদেশ ইনফর্মেশন সেন্টার— মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলার কাজ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পর ইউনূস দেশে ফেরেন, যোগ দেন যোজনা কমিশনে। তার পর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্রের বিভাগীয় প্রধান হন।
দুনিয়া তাঁকে চিনেছে ক্ষুদ্র ঋণের জনক হিসাবে। সেই যাত্রার সূচনা ১৯৭৬ সালে, যখন ইউনূস দেখেন যে, চড়া সুদের মহাজনি ঋণ ছাড়া গরিব মানুষদের ব্যবসা করার জন্য ঋণ পাওয়ার আর দ্বিতীয় পন্থা নেই। প্রথমে নিজের সঞ্চিত টাকা থেকেই ৪২ জনকে ঋণ দিলেন ইউনূস। তার পর শুরু হল এই প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ গ্রহণ। ১৯৮২ সালে তাঁর সংস্থার ঋণগ্রাহক সদস্যের সংখ্যা দাঁড়াল ২৮,০০০। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হল গ্রামীণ ব্যাঙ্ক— সংস্থার বয়স পঁচিশ বছর হওয়ার আগেই, ২০০৭ সালে, তার ঋণগ্রাহকের সংখ্যা ছিল ৭৪ লক্ষ, এবং মোট প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ সাড়ে ছ’শো কোটি ডলার। ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণের এই মডেলে অনুপ্রাণিত হল শতাধিক উন্নয়নশীল দেশের সংস্থাও।
তাঁর হাতে গড়া গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ক্রমশ শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে উন্নয়নের বিভিন্ন পরিসরে। তৈরি হয় গ্রামীণ মৎস্য ও গ্রামীণ কৃষি— যথাক্রমে মৎস্যজীবীদের নিয়ে প্রকল্প, এবং ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্প। গ্রামীণ টেলিফোন বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশনের প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প নিয়ে অবশ্য প্রশ্নও উঠেছে অনেক। তবে, এই প্রকল্পই তাঁকে ২০০৬ সালে এনে দিয়েছিল নোবেল শান্তি পুরস্কার।
অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, বাংলাদেশের কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গেই তাঁর দীর্ঘমেয়াদি ভরসা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়নি— কিন্তু তাঁকে এক রকম মেনে নিতে হয়েছে সবাইকে। ব্যতিক্রম শুধু শেখ হাসিনা। ২০০৫ অবধি তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল মসৃণ, ২০০৬-এ নোবেল প্রাপ্তি হাসিনার মনে ইউনূস সম্পর্কে আশঙ্কার সঞ্চার করে। মুজিব-কন্যা এই নোবেলজয়ীর মধ্যে তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। পরের বছরই ইউনূস রাজনৈতিক দল খোলেন, শেখ হাসিনা তাঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। ‘নাগরিক শক্তি’ দলটি অবশ্য কয়েক মাসেই গুটিয়ে যায়, কিন্তু ইউনূসের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয়ে যায়। তার পর থেকেই দেশে রাষ্ট্রীয় রোষের ‘শিকার’ তিনি।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী, এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। ইউনূসের ভূমিকা ঠিক কী হতে চলেছে, তা-ও এখনও স্পষ্ট নয়। অস্বীকার করা যায় না যে, অন্তত প্রথম পর্বে তিনি ৩২ নম্বর ধানমণ্ডি ঠিকানার বাড়ি পোড়ানো ও শেখ মুজিবের মূর্তি ধ্বংসের মতো কাজের নিন্দা করেননি। বঙ্গবন্ধু-হত্যার পঞ্চাশ বছরের শুরুতে তাঁর প্রতি শোক প্রকাশেও তাঁর সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
কিন্তু, এ কথাও অনস্বীকার্য যে, অন্তত আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতে এই মুহূর্তে মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বহুমুখী রাজনৈতিক স্রোতের মধ্যে থেকে দেশকে স্থিতিশীলতায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য অশীতিপর ইউনূসের উপরেই ভরসা করেছে সব পক্ষ। তাঁর দীর্ঘ যাত্রাপথ যদি অন্তত একটি ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়, তা হল, তিনি স্বপ্ন দেখতে জানেন, সেই স্বপ্নের পথে হাঁটতে জানেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সম্ভবত তাঁর সেই স্বপ্ন দেখার ক্ষমতার উপরেই ভরসা করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy