নিজেকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াই থেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা ঘোষণা করে জোসেফ বাইডেন যখন জানালেন, তরুণ কণ্ঠের জন্য একটা স্থান ও সময় আছে, একান্ন বছর পূর্বের ইতিহাস কড়া নাড়ল যেন! ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে তিনি যখন নির্বাচন জেতেন, তাঁর বয়স ছিল ত্রিশ বছরের সামান্য কম। সেনেট হওয়ার ন্যূনতম চৌকাঠে পৌঁছনোর (৩০ বছর) আগেই সংবাদমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁর উপর। তরুণ, এলভিস প্রিসলের মতো ঝুলফির অধিকারী, সুদর্শন বাইডেন তখনই তারুণ্যের জয়গান গেয়েছিলেন। বলেছিলেন, অল্পবয়স্কদের রাজনীতি ও প্রশাসনে আসা আমেরিকার জন্য শুভ কথা।
কিন্তু আজ এই অশীতিপর বৃদ্ধ কিছুতেই বুঝতে চাইছিলেন না যে মশালটা তাঁর হাতে আর থাকছে না। কালের নিয়মে তিনি অশক্ত, জরাগ্রস্ত। রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী পরাক্রান্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিভিশন বিতর্কে কথার খেই হারালেন, দৃশ্যতই অপ্রতিভ বাচনে কণ্ঠ বুজেও আসছিল তাঁর। সেই ৩০ বছরের টগবগে তরুণের এক ক্লান্ত রিক্ত ছায়া ছাড়া আর কিছুই নন তিনি, আরও যেন বেশি করে বুঝল আমেরিকাবাসী। তাঁর দ্বিতীয় বারের জন্য নির্বাচনে দাঁড়ানো নিয়ে আপত্তির তরঙ্গ ছিলই ডেমোক্র্যাট শিবিরে। এর পর তা দ্রুত ঢেউয়ের আকার নিল। হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভ-এর প্রাক্তন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির মতো বেশ কয়েক জন শীর্ষস্থানীয় ডেমোক্র্যাট নেতা-নেত্রী বাইডেনকে ‘দলের স্বার্থে’ প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোর আর্জি জানান। সেই তালিকায় ছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। গোড়া থেকে যে প্রত্যয় দেখিয়েছিলেন, তা আর ধরে রাখতে পারলেন না বাইডেন। টেলিভিশন বিতর্কের পর সর্বনাশ আসন্ন, তা তাঁর মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ বোঝেননি তা তো নয়। আর তাই ভিতরে ও বাইরের প্রবল চাপের মধ্যে পড়ে এই অভূতপূর্ব পদক্ষেপ। প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড় শুরু করেও নির্বাচনের সাড়ে তিন মাস আগে জানিয়ে দিলেন তিনি সরে যাচ্ছেন। মশাল অন্যের হাতে তুলে দেবেন দেশের ভাল চান বলে। আপাতত এটুকু লক্ষণীয়, তিনি সরে দাঁড়ানোর পর তাঁর দল এবং গোটা দেশেই মিশ্র আবেগের ছড়াছড়ি। তাঁর এগারো মিনিটের বিদায়ী বক্তৃতার পর হোয়াইট হাউসের সামনে মানুষের ভিড়। তাঁদের হাতে প্ল্যাকার্ড, গত চার বছরে তাঁর কাজের জন্য। যদিও বাইডেনের সরে দাঁড়ানো আমেরিকার নির্বাচনে কী ভাবে প্রভাব ফেলবে তা বলার সময় এখনও আসেনি।
আপাতত বাইডেনের এই হার মানতে না চাওয়া এবং পরিশেষে বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত এবং বহু টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া তাঁর ব্যক্তিসত্তা— এই দুইয়ের মধ্যে জল-অচল কোনও পাঁচিল নেই বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বরং তা একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্তও বটে। তাঁর দীর্ঘ পাঁচ দশকের যাত্রাপথের একটি দিক যদি হয় বর্ণময়, অন্য পিঠ ঘষা কাচের মতো বিবর্ণ। আজ অপেক্ষাকৃত কর্মহীন প্রায় পূর্ণ অবকাশে আসন্ন পাতা ঝরার মরসুমি বাতাসে বৃদ্ধ বাইডেনের ঈষৎ ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টি নিশ্চয়ই ফিরে দেখছে নিজের রাজনৈতিক সূচনা পর্ব, যার হরিষে বিষাদকে অতিনাটকীয়তায় বিশ্বাসী কোনও চিত্রনাট্যকারও ছোঁয়ার আগে দু’বার ভাববেন। সেনেটর হওয়ার এক মাসের মধ্যেই মোটর দুর্ঘটনায় স্ত্রী নায়লা বাইডেন এবং এক বছরের কন্যা নাওমির মৃত্যু। সেই গাড়িতে থাকা বাকি দুই পুত্রের মারাত্মক জখম হওয়া এবং প্রাণরক্ষা। ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখতে হত তাঁকে হাসপাতালে, জাগ্রত অবস্থাতেও তাঁর মনে হত কোনও অনন্ত খাদের মধ্যে ক্রমশই পড়ে যাচ্ছেন। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সামনের উজ্জ্বল রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে অন্ধকার বলে মনে হয়েছিল তখন। সেনেটের নেতা মাইক ম্যানসফিল্ডকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, নিজের আসন থেকে সরে দাঁড়াতে চান। জখম দুই সন্তানও তখন শয্যাশায়ী। তাঁদের সবার পাশে ছিলেন অতন্দ্র বাইডেনের বোন ভ্যালেরি।
ম্যানসফিল্ড এবং বিশেষত ভ্যালেরি তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, এক জন দায়িত্বশীল পিতা এবং সেনেটর হওয়ার মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা নেই। রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরতে রাজি হন বাইডেন। ওয়াশিংটন থেকে কর্তারা আসেন তাঁর হাসপাতালে। ৭৩-এর জানুয়ারিতে তাঁর হাসপাতালের ঘরে হুইলচেয়ারে নিয়ে আসা হয় দুই পুত্রকে, তাঁদের সবার উপস্থিতিতে সেনেটর হিসাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে শপথ গ্রহণ করেন বাইডেন। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় জানান, ছ’মাসের মধ্যে যদি দেখেন এক জন যোগ্য পিতা এবং সেনেটরের ভূমিকার মধ্যে সংঘাত হচ্ছে, সরে দাঁড়াবেন। নিজের শহর থেকে অ্যামট্র্যাক রেলে ওয়াশিংটন যাতায়াত করতেন সে সময়, যাতে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে ছেলেদের সঙ্গে থাকতে পারেন।
কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পরে সাংবাদিকদের বাইডেন জানিয়েছিলেন, তিনি সবার সেনেটর হতে চান, সবার কথা শুনতে চান, শুধুমাত্র নিজের দলেরই নয়। বলেছিলেন, “আমার বয়স ত্রিশ, এই মুহূর্তে সবচেয়ে কমবয়সি সেনেটর আমি। যদি নিজের তাস ঠিকমতো ফেলতে পারি এবং ভাল ভাবে চলতে পারি, হয়তো আরও চল্লিশ বছর এখানে থাকতে পারব।”
অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী। ৩৬ বছরের দীর্ঘ সেনেটর জীবন, তার পর টানা আট বছর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে (২০০৯ থেকে ২০১৭) অবশেষে আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্টের আসনে বসেছেন বাইডেন। বিপুল ব্যক্তিগত বিপর্যয়, সেই অনন্ত ভার্টিগো থেকে মুক্তি পেতে তিনি তাঁর রাজনীতি এবং কর্মজীবনকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, যা তাঁর চামড়ার অংশ হয়ে গিয়েছিল এত দিনে। ২০১৫ সালে ক্যানসারে আরও এক সন্তানের মৃত্যুর পরেও যা বাইডেনকে অবিচল রেখেছিল। আর তাই তাসের দানটা হাত থেকে যে এক সময় ছেড়ে দিতেই হয়, তা মেনে নিতে পারছিলেন না হয়তো। টেলিভিশন শো-এর ঝাঁকানিটার প্রয়োজন হল তাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy