Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Gulzar

নামভূমিকায়: গুলজ়ার

গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালকের বিবিধ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে আজও তিনি নিজেকে প্রধানত কবি বলেই জানেন। জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত হলেন গুলজ়ার।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৯
Share: Save:

পুরনো দিল্লির রোশনারা রোডে একটি ক্লক টাওয়ার। তার উল্টো দিকের একটি স্টোর রুমে শুতে যায় বছর
দশেকের বালক। বিদ্যুৎ নেই, সময় কাটে কী ভাবে! ভাগ্যক্রমে সামনেই একটি ছোট বইয়ের দোকান। হপ্তায় চার আনা দিয়ে বই ভাড়া করার ব্যবস্থা। গোগ্রাসে উর্দুতে ডিটেকটিভ বই পড়ে বালকটি, যত ক্ষণ না লন্ঠনের আলো ঢিমে হয়ে যায়। বালকের পড়ার গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন না স্টল মালিক। ভাবেন, মাত্র চার আনা দিয়ে আসলে এক টাকার বই পড়ে ফেলছে হতচ্ছাড়া!

এমনই এক সময়ে, জীবন-বদলে-যাওয়া রাত আসে সেই বালকের। শুতে যাওয়ার আগে, রাতের ‘খাদ্য’ সংগ্রহে গিয়েছে সে— বইয়ের দোকানের মালিক বেজার মুখে বলে, “সব ফাঁকা, একটাই বই পড়ে আছে। নিতে হলে নাও।” বইটি ছিল ১৯১৩ সালে ম্যাকমিলান লন্ডন প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি কবিতা সঙ্কলন দ্য গার্ডেনার-এর উর্দু অনুবাদ। বালক সেই বই নিয়ে আসে, রাতের ঘুম উড়ে যায় তার। আমর্ম রবীন্দ্রনাথে ডুবে যাওয়ার সেই শুরু। ওই রত্নখনির মতো স্টল থেকেই এর পর সে একে একে পড়বে বঙ্কিমচন্দ্র এবং শরৎচন্দ্রের অনুবাদ। দ্য গার্ডেনার বইটি বার বার করে স্টল মালিককে দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই এক দিন নিজের কাছে রেখে দেবে সেটি, আর ফেরত দেবে না! গোটা দেশের জনরুচির উপর পরবর্তী সময়ে যে আলো পড়বে তার, সূচনা হয়েছিল সেই লন্ঠনের ঢিমে আলোয়।

জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই মাতৃহারা গুলজ়ারকে সাত বছর বয়সে ঝিলাম জেলার (অধুনা পাকিস্তান) দিনা থেকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন বাবা সর্দার মাখন সিংহ কালরা। ব্যবসার কারণে দিল্লিতে যাতায়াত ছিল তাঁর, একটা দোকানও ছিল শহরে। একটি বাড়িও ভাড়া নিয়েছিলেন মাখন সিংহ। দিনের বেলা সেখানে থাকলেও গুলজ়ার রাতে শুতে যেতেন ওই স্টোর রুমেই।

যখন তাঁর বয়স বছর দশেক, কাশ্মীরি গেটের কাছে দিল্লি ইউনাইটেড খ্রিস্টান স্কুলে শুরু হয় ক্লাসরুমে ‘বায়েত-বাজি’। ‘বায়েত’, অর্থাৎ শায়রি। অন্ত্যাক্ষরীর মতোই দু’দিকের বেঞ্চ ভাগ করে কবিতা শিক্ষক মৌলবি সাহেব চালাতেন এই খেলা। এক পক্ষের কবিতার শেষ অক্ষর থেকে অন্য দিকের শুরু। জোরালো প্রতিপক্ষ ছিলেন বন্ধু আকবর রশিদ, যিনি নাকি যে কোনও বর্ণ থেকে গোটা তিনেক শায়রি মুখস্থ বলতে পারতেন। যাঁকে স্কুল ছাড়ার পরে অনেক খুঁজেছেন গুলজ়ার, কিন্তু দেখা পাননি।

গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকারের মতো পরিচয় ছাপিয়ে কবিতাকে নিজের ভিতরে ধরে রেখেছেন গুলজ়ার, আজীবন। হিন্দি সিনেমার গানে কবিতাকে বুনে দিয়েছেন, তাঁর প্রিয় সাহির লুধিয়ানভির মতোই। নিজেই বলেছেন, ছবিতে সূর্যাস্তের আয়োজন করতে তাঁকে ক্যামেরা, লেন্স, ফোকাল পয়েন্ট, আলোর মাপের হিসাবে দিশেহারা হতে হয়— তবে তৈরি হয় একটি সার্থক সূর্যাস্ত। কিন্তু নিজের কবিতায় যখন সূর্যকে পাটে তোলেন গুলজ়ার, সেই অপার্থিব গোধূলি তাঁর নিজস্ব কল্পনাসঞ্জাত। সেখানে তিনি স্বরাট।

পিতৃদত্ত সম্পূরণ সিংহ কালরা নামটিকে বদলে লেখক-নাম গুলজ়ার করায় তৎকালীন জনপ্রিয় উর্দু কবি রাজিন্দর সিংহ বেদি পরামর্শ দিয়েছিলেন, “সঙ্গে কিছু জোড়ো হে। নয়তো ফাঁকা শোনাচ্ছে।” বিনম্র আত্মবিশ্বাসে তিনি উত্তর দেন, “অন্যান্যরা চাইলে নাম বদলে ফেলতে পারেন। আমি এই নামটি ছাড়ছি না।” জন্মসূত্র শিখ, বেড়ে উঠেছেন দিল্লিতে, উত্তরপ্রদেশের সংস্কৃতি খান-পানের মধ্যে। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়ে ক্রমশ মহারাষ্ট্রবাসী হয়ে উঠেছেন পরে। তাঁর উর্দু উচ্চারণ শুনে তাঁকে মুসলমান বলে ভুল করেন অনেকে। গুলজ়ার বলেন, “সংস্কৃতিমনস্কতায় আমি তো মুসলমান বটেই।” আবার তাঁর বাঙালি স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ-প্রেম, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বিমল রায়, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় ও গণনাট্য সঙ্ঘের বাঙালি বন্ধুদের সখ্যে, বাঙালি সত্তাও পরিব্যাপ্ত। তিনি আসলে সর্বভারতীয়।

সলিল চৌধুরীদের সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের শেষে মুম্বই কয়্যারে গান বাঁধার সেই সব দিন আর মুম্বইয়ের একটি গ্যারাজে কাজ করার মধ্যেই বিমল রায়ের বন্ধু, দেবু সেন তাঁর কাব্যপ্রতিভার খোঁজ পেয়ে বলেছিলেন সিনেমায় গান লিখতে। গুলজ়ার নারাজ। নিয়তি মুচকি হেসেছিল সে দিন! দেবু গুলজ়ারকে বুঝিয়েছিলেন সে দিন, “তোমার কী ধারণা, সব পরিচালকই অশিক্ষিত? এক বারটি গিয়েই দেখো না।” তিনিই নিয়ে গেলেন বিমল রায়ের কাছে, যিনি গুলজ়ারের সঙ্গে শচীন দেব বর্মনের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

গীতিকার শৈলেন্দ্রর সঙ্গে তখন মনোমালিন্য চলছে শচীনকর্তার। বন্দিনী ছবির গান ঝুলে রয়েছে, কাজিয়ার জেরে সরে গিয়েছেন শৈলেন্দ্র। বৈষ্ণবভাবাপন্ন একটি গানের প্রয়োজন। উর্দু কবিতায় গুলজ়ারের হাতযশের কথা জেনেও খুব একটা উৎসাহ পাননি কর্তা। কারণ সহজবোধ্য, তিনি বৈষ্ণব ভাষ্য খুঁজছিলেন। জেদ চেপে গেল গুলজ়ারের, রচিত হল তাঁর প্রথম ফিল্ম সঙ্গীত, “মোরা গোরা অঙ্গ লেই লে, মোহে শ্যাম অঙ্গ দেই দে!” এর পর শৈলেন্দ্রর সঙ্গে কর্তার আবার মিটমাট হয়ে যায়, কিন্তু জহুরি বিমল রায় চিনে নিলেন রত্ন। ছবি পর্দায় এলে গানটি সুপারহিট হল।

তখনও গ্যারাজের কাজ ছাড়েননি গুলজ়ার। সেখানে নিজে গিয়ে বিমল রায় বোঝালেন তাঁকে, “সিনেমা পরিচালকের মাধ্যম, সে তুমিও জানো আমিও জানি। তোমাকে তাই শুধু গান লেখার জন্য আটকে রাখব না আমি। কাবুলিওয়ালা ছবি করছি, তুমি আমার সহকারী পরিচালক হিসাবে
কাজ করো।”

বাকিটা ইতিহাস। গত ছ’দশকের প্রবহমান হাওয়াকে ফুসফুসে ধারণ করে নিজেকেও নতুন নতুন করে খুঁজে চলেছেন গুলজ়ার। এই নব্বইয়েও তিনি মনের ক্যানভাসকে রেখেছেন তাঁর প্রিয় পোশাক কুর্তা পাজামার মতো ধবধবে। সময়ের মাধুর্য যেখানে তার অনিবার্য দাগ রেখে চলেছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Jnanpith Award Personality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy