ধর্ম বিশারদদের প্রশ্ন, যা হাদিসে নেই, সেই মৌখিক তিন তালাক আবার আইন করে বন্ধ করার কী প্রয়োজন? আসলে এ এক রাষ্ট্রীয় ফন্দি। মানে যা ছিল না, তা আবার বন্ধ কী করে হয়?
কিন্তু কেউ যদি নতুন কিছু সৃষ্টি করে অত্যাচার করে তবে তার উৎসকে আইনি পথেই বন্ধ করতে হবে। তবে প্রশ্ন অন্য জায়গায়। তিন তালাক দেওয়া স্বামীকে জেলে পাঠালে স্ত্রীর যে কী নিদারুণ সমস্যা হবে তা অনুমান করাই যায়। গাঁ-গঞ্জে ‘স্বামীকে জেলে পাঠানো’ স্ত্রীকে হাজারও বিদ্রুপ সহ্য করতে হবে। চাপ আসবে শ্বশুরবাড়ি থেকে— ‘‘যাও গিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এসো। নইলে দেখো কী করি!’’ অন্য দিকে বাবার বাড়ির লোকজনও দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন, ‘‘স্বামীকে জেলে পাঠালি! আমাদের সম্মানের কথা এক বারও ভাবলি না?’’
তালাকপ্রাপ্ত মরিয়ম বলছেন, ‘‘তা হলে কি শাস্তি দেওয়া যাবে না? স্বামী অন্যায় করলে শাস্তি হবেই। মেয়েরা তো এত দিন ভুগল। স্বামীদেরও ভয় পাওয়া দরকার।’’ সমাজকর্মী ও শিক্ষিকা সাবিনা সৈয়দের কথায়, ‘‘তবে কি এ বার চোরকে ধরার আগেও রাষ্ট্র ভাববে চোরের পরিবারের কথা? অপরাধ তো অপরাধ। এখানে সম্পর্কের প্রসঙ্গ আসছে কোথায় থেকে? যে কোনও ধরনের তালাক স্ত্রীর মর্যাদার পক্ষে অনুপযুক্ত। বিয়ে হবে যৌথ মতে। বিচ্ছেদও হবে যৌথ আপসে। সেখানে তৃতীয় প্রসঙ্গ একেবারে অপ্রাসঙ্গিক।’’
কিন্তু শুধু স্বামীদের ভয় পাওয়ানোর জন্য কি আইন হতে পারে? মুসলিম মহিলা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আফরোজা খাতুন অভিযোগের সুরে বলছেন, ‘‘মেয়েদের কোন অধিকারের কথা বিলে বলা আছে? এই বিলের ফলে মেয়েদের কী উপকার হল? গার্হস্থ্য হিংসা আইন তো আছেই। তা হলে আলাদা করে এই বিল কেন? তা ছাড়া বিচ্ছিন্ন দম্পতি আবার যদি ফিরতে চায় সংসারে তবে কি সেই মহিলা আবার নিকা হালালার মতো বর্বরতার মধ্যে দিয়ে ফিরবেন? সেটার কী সমাধান আছে বিলে?’’
প্রশ্ন উঠছে, মুসলিম মেয়েদের অত্যাচারের সীমানা কি মৌখিক তাৎক্ষণিক তিন তালাকেই বাঁধা থাকবে? বাকি অন্যায় যে প্রথা রয়ে গেল তার জন্য কি আরেকটি বিল আসবে? সেটা কবে? স্ত্রী অপমানিত হবেন। কিন্তু শুধু দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের জন্য পড়ে থাকবেন স্বামীর আশ্রয়ে! এ কোন প্রাতিষ্ঠানিক দায়? দাম্পত্যে সম্মান না থাকলে বিয়ে কী জন্য? বিয়ে দ্বিপাক্ষিক। বিচ্ছেদও দ্বিপাক্ষিক। ধর্মেও মুসলিম স্ত্রী মর্যাদায় আসীন। কিন্তু ধর্ম মেনে দাম্পত্য চলে না। চলে স্বামীর মর্জি মতো।
স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের পরে বড় চাপ আসে সন্তানের উপরে। মা-বাবাই ছোট্ট সন্তানের একমাত্র জগৎ। এই বিচ্ছেদের সবথেকে বেশি প্রভাব পড়ে তার উপরে। সে বুঝতে পারে না তার কী করা উচিত। সে সময় তাকে বোঝানোর কেউ নেই। মা–বাবা নিজেদের অধিকারের লড়াই নিয়ে ব্যস্ত। নিজেদের দ্বন্দ্ব নিয়ে চুলচেরা হিসেব বুঝে নিতে থাকে। এ দিকে শিশুটির শৈশব চুরি হতে থাকে। তার জন্য কোনও আইনি ধারা নেই। দৈববলে তা ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও উপায়ও কারও জানা নেই। এই শিশুদের জন্য জরুরি নতুন কিছু বিধান। মা তালাকপ্রাপ্ত, বাবা জেলে, তা হলে সন্তানের কী হবে?
তাৎক্ষণিক তালাকপ্রাপ্ত মহিলা স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবেন। কিন্তু রক্তের সম্পর্কের কাউকে তিনি পাশে পাবেন তো? একা অভিযোগ জানাতে যাওয়ার সাহসই বা ক’জন মহিলার আছে? বেশিরভাগ মেয়ে স্বামীর বাড়ির অত্যাচারকে বিয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ জেনে এসেছেন। তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, ‘‘এটুকু সহ্য করতে পারছিস না? শ্বশুরবাড়িতে তো একটু জ্বালাতন করবেই।’’ তাই স্বামী বেআইনি তালাক দিলে তাঁকে শাস্তি দিতে জেলের দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। আবার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী শাস্তিপ্রাপ্ত স্বামীর অনুপস্থিতে কোথায় থাকবেন সেটাও বড় প্রশ্ন। তাঁর আশ্রয় ও নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবেন? সরকার পক্ষ সে নিয়ে নীরব। স্বামীর পরিবারের অত্যাচারে তিনি যদি বাধ্য হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করে স্বামীকে ফিরিয়ে আনেন, তার পরের সমস্যাও বহুমুখী। এক, তাঁর উপর অত্যাচার বাড়বে। দু্ই, আদৌ তাঁর দাম্পত্যের আয়ু কত দিন থাকবে তা সংশয়ের। এই মামলার পরবর্তী সমস্যায় কি আইনি সহায়তা স্ত্রী পাবেন? এই প্রশ্নগুলোরও স্পষ্ট কোনও উত্তর মিলছে না।
তালাকপ্রাপ্ত মহিলাদের স্বনির্ভর করে তুলতে বিশেষ সরকারি সাহায্য প্রয়োজন। তা ছাড়া বাবা-বিচ্ছিন্ন শিশুকেও একটি ভাল বিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া দরকার। স্বামী ছেড়ে দিয়েছে বলে সেই মহিলাকে বিষ নজরে দেখার সামাজিক কুঅভ্যাসেরও বদল জরুরি। তাই এমন পরিবেশ ও আইনি সাহায্য জরুরি যাতে তিক্ততা কমে। সম্পর্কে বিচ্ছেদ আসতেই পারে। কিছুই অনিবার্য ও অপরিহার্য নয়। কিন্তু শিশুর কাছে মা-বাবাই সব। হোক না বিচ্ছেদ। কিন্তু শিশু জানুক, আব্বা-আম্মা একসঙ্গে থাকে না। কিন্তু ভাল বন্ধুত্ব আছে দু’জনের। এটাই তালাকের বড় দায়। দাম্পত্যের সবচেয়ে বড় ঋণ। স্বামী-স্ত্রীর এটা পরিশোধ করা কর্তব্য। পরবর্তী প্রজন্মের মুখের হাসিটা বহাল রাখতে পারাটাই শেষ কথা। এই সন্তানের জন্যই বিবাহ প্রতিষ্ঠান। কচিকাঁচাদের লালনের জন্যই ধরিত্রীর বুকে সংসার পাতা।
ধর্ম শুধু বিধান দেয়। মানা ও না মানা নিজের বিষয়। দাম্পত্য নির্মাণ করে মানবিকতার শৃঙ্খল। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের উত্তরণের সাক্ষী থাকে এই সম্পর্ক। এতে বাঁধ দেওয়া কর্তব্য স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই। আইন বেঁধে দেয় অধিকারের লক্ষ্মণরেখা। হিসেব বুঝে নেওয়ার পথ দু’জনেরই খোলা থাকে। কিন্তু তালাক বা বিচ্ছেদ হোক ন্যায়সঙ্গত ও প্রয়োজনভিত্তিক, অত্যাচারের মাধ্যম বা অন্যায়ের হাতিয়ার নয়। সম্পর্কের ভাঙন অনিয়ন্ত্রিত। কিন্তু সৌজন্যটুকু অন্তত থাক। স্বাধীনতা থাক দম্পতির সিদ্ধান্তে। উত্তরসূরীদের প্রতিও থাক অটুট কর্তব্যবোধ। কবুল তিন বার দিয়ে সম্পর্কের শুরু। তালাক তিন বার ভুল ভাবে বা নিয়ম মেনে বলে সম্পর্ক শেষ। কিন্তু সন্তানদের ললাটলিখনের সুযোগ মাত্র এক বার। এখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার মেরামতির সময় কিংবা সুযোগ কোনওটাই নেই।
তাই দায়িত্বহীন যথেচ্ছাচার বন্ধের সতর্কবার্তা হিসেবে ও পুরুষের খবরদারি রুখতে তালাক বিল মুসলিম মহিলাদের প্রতি সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার নজির। যে কোনও ধরনের পদ্ধতিগত তালাককে বিদায় জানানোর এটাই উপযুক্ত সময়। মেয়েদের আন্দোলন আরও জোরদার হোক। বন্ধ হোক বিয়ের নামে মেয়েদের উপর অত্যাচার ও সমাজ সমর্থিত পক্ষপাতিত্ব। স্বামীর উপর দেবত্ব আরোপের দিন শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এ বার বেয়াড়া স্বামীর উপর মনুষত্ব্য আরোপের ভার স্ত্রীর হাতেই থাক। সংসার বাঁচুক। বাঁচুক শিশুর ভবিষ্যৎ।
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy