স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। ছবি: এএফপি
স্বাধীনতা দিবসের মঞ্চ হইতে ভারতে জনসংখ্যার আধিক্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনের উপর জোর দিয়া প্রধানমন্ত্রী কি কোনও গূঢ় সঙ্কেত দিতে চাহিয়াছেন? অধুনা যে ধরনের সঙ্কেতকে ‘ডগ হুইসল’ বলা হইয়া থাকে? শব্দবন্ধটির তাৎপর্য: নেতা বা নেত্রী তাঁহার ভাষণে এমন একটি কথা বলিলেন, যাহার গভীরে নিহিত সঙ্কেত শ্রোতাদের নিকট, অনেক সময়েই তাহাদের একটি অভীষ্ট অংশের নিকট এক বিশেষ অর্থ বহন করিল, তাহাদের মন ওই নিহিত বাঁশির ধ্বনিতে সাড়া দিল। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য সম্পর্কে এমন সংশয় হয়তো সম্পূর্ণ অহেতুক নহে— জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ ও আহ্বান এই দেশে অনেক সময়েই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সামাজিক বিভাজনের প্রকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হইয়াছে। কিন্তু আপাতত সন্দেহের কাঁটা সরাইয়া রাখিয়া তাঁহার উদ্বেগ ও পরামর্শকে সহজ ভাবে গ্রহণ করিয়া ধরিয়া লওয়া হউক যে, তিনি কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য গূঢ় সঙ্কেত দিতে চাহেন নাই, সাধারণ ভাবেই জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে লাগাম পরাইবার কথা বলিয়াছেন। জনবাহুল্য এবং অত্যধিক জন্মহার লইয়া এমন উদ্বেগ ভারতে অনেক কাল ধরিয়াই সুপরিচিত।
এবং বহুলাংশে অপ্রাসঙ্গিক। যাঁহারা এখনও সত্য সত্যই এই দেশের জনবিস্ফোরণ লইয়া দুশ্চিন্তায় ভোগেন, তাঁহারা নিশ্চয় জানেন না যে, পৃথিবী বদলাইয়া গিয়াছে, ভারতও। এই দেশে জনসংখ্যা বিপুল, বহু অঞ্চলেই জনবসতির ঘনত্বও অত্যধিক, কিন্তু তাহা অতীতের উত্তরাধিকার। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সেই অতীত হইতে ভিন্ন। প্রধানত উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে, দেশে সন্তান-জন্মের এবং তজ্জনিত জনবৃদ্ধির হার ইতিমধ্যেই যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত। বস্তুত, বেশ কয়েকটি রাজ্যে জন্মের হার এতটাই কম যে, সেই হার বজায় থাকিলে ভবিষ্যতে সম্ভবত জনসংখ্যা কমিতে থাকিবে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ অতীতের উত্তরাধিকার। এবং, অতীত মৃত।
প্রকৃত উদ্বেগের কারণ অন্য। একাধিক কারণ। এক, উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সত্যই এখনও মাত্রাতিরিক্ত। দুই, ইতিমধ্যে যে বিপুল জনসমষ্টি, বিশেষত অল্পবয়স্করা, শিক্ষা ও কাজের দুনিয়ায় প্রবেশ করিয়াছে, তাহাদের এক বিরাট অংশের চাহিদা অপূর্ণ। শিক্ষার মান অনেকাংশেই ভয়াবহ, কর্মসংস্থানের চিত্র আতঙ্কজনক, যাঁহাদের কাজ আছে তাঁহাদেরও অধিকাংশেরই কাজের গুণমান অত্যন্ত খারাপ। এই সমস্যা মোকাবিলার উপায়, এক কথায়, শিক্ষার প্রসার, পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের প্রসার, কর্মসংস্থানের প্রসার। অর্থাৎ, যথার্থ সর্বজনীন উন্নয়ন। সেই কাজটি সাধন করিতে পারিলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাকি কাজটুকুও আপনিই সম্পন্ন হইবে, জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য কোনও অ-গণতান্ত্রিক জবরদস্তির নীতি ঘোষণা করিবার বা সঙ্কেত পাঠাইবার প্রয়োজন হইবে না। ভারত-সহ গোটা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা বলে, সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটিলেই পরিবারের আয়তন স্বাভাবিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। জবরদস্তি জন্মনিয়ন্ত্রণের ফল শেষ অবধি ক্ষতিকর হইতে বাধ্য, চিন তাহার সাক্ষ্য বহন করিতেছে। প্রধানমন্ত্রী যদি উদ্বিগ্ন হইতেই চাহেন, তবে মিথ্যা উদ্বেগ ছাড়িয়া সত্য উদ্বেগে উদ্বিগ্ন হউন এবং তাহা দূর করিতে যত্নবান হউন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy