প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং
ছয় ঘণ্টা। দুই বৃহৎ দেশের শীর্ষনেতার বৈঠকের পক্ষে খুব বেশি সময় নয়। কিন্তু তাহার মধ্যে যেটুকু ঘটিল, তাহা পর্যাপ্ত বলা চলিতে পারে। মমল্লপুরমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংকে তাঁহার পোর্ট্রেট-আঁকা যে সোনালি-লাল কারুকাজখচিত হস্তরচিত শালটি উপহার দিলেন, তাহার মতোই এই বৈঠকের মূল্য নেহাত আলঙ্কারিক কি না, নানা পক্ষ হইতে এই প্রশ্নটি উঠিতেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলিতে হয়, এই সব বৈঠক সাধারণত যেমন হইয়া থাকে, তাহার মানদণ্ডে ইহা যথেষ্ট সফল। মোদী ও শি-র মধ্যে যে কথাবার্তা হইয়াছে, তাহা আলঙ্কারিক বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে। স্পষ্ট বলা দরকার যে, ভারতীয় স্বার্থ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী যাহা বলিতে পারিয়াছেন, এবং আদায় করিতে পারিয়াছেন, তাহার মূল্য অনেক। কারণ প্রধানত দুইটি। প্রথমত, ভারতের পরিস্থিতি। দ্বিতীয়ত, চিনের পরিস্থিতি। লোকসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের দুইটি বৃহত্তম দেশের মধ্যে ক্ষমতার সত্যকারের তারতম্য বিরাট, ভারতের কূটনৈতিক গুরুত্ব চিনের অনেক নীচে, এই সব কথা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের অপেক্ষা চিনের জাতীয় গড় উৎপাদন পাঁচ গুণের বেশি। প্রতিরক্ষায় দিল্লি যে অর্থ ধার্য করে, বেজিং করে তাহার তিন গুণেরও অধিক। চিনের কূটনৈতিক বাহিনীর পরিমাণ ভারতের পাঁচ গুণ। তফাত বেশি থাকিলেও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেক সময় কিছু সুবিধা দেয়। যেমন, ২০০৩-২০০৭ সালের মধ্যে চিন ভারতকে আর একটু সমীহের চোখে দেখিত, কেননা জিডিপির দিক দিয়া পার্থক্য এই রকম বিপুল থাকিলেও ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার তখন ছিল বেশি, চিনের অপেক্ষাও বেশি! এখন ভারতীয় অর্থনীতির হাল যেমন, তাহাতে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন মুখে যাহাই বলুন, তাঁহার রাতের নিদ্রা যে সুনিদ্রা নহে তাহা নিশ্চিত। সুতরাং, বুঝিতে অসুবিধা নাই, ভারত কেন বর্তমান কূটনীতির মঞ্চে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থিতাবস্থার পক্ষে, আর চিন কেন অধিকাংশ সময়ে স্থিতাবস্থা পাল্টাইবার ঔদ্ধত্যে ভরপুর। এমতাবস্থায় ভারত ও চিন মুখোমুখি হইলে পরিণতি যাহা ঘটিবার কথা, তদপেক্ষা ভাল ঘটিয়াছে— ইহাই কি একটি সুসংবাদ নহে?
বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি বৈঠকে গুরুত্ব পাইয়াছে, ভারত কিছু সুবিধা আদায় করিতেও পারিয়াছে। তবে কিনা, এই স্থলেই ভারতের বাজারের দশা চিনের করুণার সামনে নেহাত অসহায়। সস্তার চিনা পণ্য যে ভবিষ্যতে ভারতের বাজার ছাইয়া দিতে এতটুকুও বিরত হইবে, এমন আশ্বাস প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী পান নাই। কিন্তু পাইয়াছেন একটি ঈষৎ কম-প্রত্যাশিত প্রতিশ্রুতি— সন্ত্রাসবিরোধিতার লড়াইয়ে সহযোগিতার আশ্বাস। পাকিস্তানের সহিত চিনের মিত্রতা সব সময়েই গভীর, কিন্তু তন্মধ্যেও কাশ্মীর বিষয়ে নৈঃশব্দ্য, এবং সন্ত্রাস বিষয়ে এই আশ্বাস ভারতবাসীকে প্রফুল্ল করিবার মতোই বটে। অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও চিনের সহিত টেবিলে বসিবার সময়ে ভারতের হাতের ভাল তাসগুলি কী কী, দিল্লি নিশ্চয় জানে। দলাই লামার সংযোগটি কী ভাবে যথাসময়ে ব্যবহার করিতে হয় ও হইবে, সেই হোমওয়ার্ক নিশ্চয় তাহার কষা আছে। আর একটি তুরুপের তাস— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত ভারতের সুসম্পর্ক। মার্কিন সম্পর্ক যে এই বিশ্বে এমনিতেই অসীম মূল্যবান, বলিবার অপেক্ষা রাখে না। তদুপরি, শত্রুর পরিচর্যা উত্তম রূপে তৈলসহযোগে করিবার কাজই বটে। এই দুই তাস হাতে শক্ত করিয়া ধরা থাকিলে বেজিং বার বার দিল্লিকে তাহার সঙ্গে বৈঠকে বসিবার আহ্বান জানাইবে, এমন আশা দুরাশা নহে। এবং মমল্লপুরমের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, বহু দুর্বলতা সত্ত্বেও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও সুবিবেচনা থাকিলে ভারত সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করিতে পারিবে, এমন ভাবাও দুরূহ নয়। এত দিনে বোঝা গিয়াছে, ক্ষমতায় নহে, বুদ্ধির ধারেই কূটনীতি কাটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy