গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সবই কি আর চিরতরে হারায়? ফিরে ফিরে আসে প্ল্যাটিনাম দিয়ে বাঁধানো কত না দিন। চলচ্ছবি হয়ে। অফিসে বসে কাজ করছি। ইডেনে, আকাশবাণী ভবনের দোতলায় সংবাদ বিভাগে। ডেস্কের একদিকে প্রণবেশদা (সেন), অন্যদিকে আমাদের সবার ‘মেজদা’, মানে নির্মল সেনগুপ্ত। এক সময় ঘরে ঢুকলেন পীযূষদা (সংবাদপাঠক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়)। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘প্রণবেশ, তোমার ছবি বেরিয়েছে, দেখেছ?’’
আমরা সবাই উৎসুক। হয়তো বা কোনও কাগজে প্রণবেশদার ছবি বেরিয়েছে। পীযূষদার দিকে তাকাতেই দেখি, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আর তর্জনীর বেষ্টনীতে ধরা একটি দেশলাই বাক্স। সেটির গায়ে শোভা পাচ্ছে একটি গরুর ছবি।
নীরবে হাসতে থাকি আমরা। প্রণবেশদা কী যেন লিখছিলেন। মাথা না তুলেই বললেন, ‘‘তরুণ, তুমি তো বেশ ভিন্গ্রহের প্রাণীদের ভাষা বুঝতে পার। পীযূষ যা বলল, ঠিক বুঝে ফেলে হাসছ দেখছি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল পীযূষদার উত্তর। আমার দিকেই তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘‘বুঝলে, প্রণবেশ তো খুর দিয়ে লেখে! তাই এ ছবিটা ওরই।’’
প্রসঙ্গত, প্রণবেশদার লেখার হাত অসাধারণ হলেও, তাঁর হাতের লেখা পড়া বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। এ ব্যাপারে তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তিটি কিন্তু ছিল অমোঘ। প্রণবেশদা বলতেন, ‘‘দেখ, আমার হাতের লেখাটা কিন্তু এক্কেবারে অরিজিনাল, অ্যাবরিজিনালও বলতে পার। চেষ্টা করলেও সহজে কেউ নকল করতে পারবে না।’’
হ্যাঁ, এমনই ছিল সেই সত্তর বা আশির দশকে আমাদের নিউজরুমের উজ্জ্বলতা।
মনে পড়ল, হাতের লেখা আর লেখার হাত— দু’টিই ভারী চমৎকার ছিল পীযূষদার। বহু গুণান্বিত ছিলেন তিনি। একদিন ধরে বসলাম, ‘‘একটা ছড়া লিখে দেবেন পীযূষদা?’’ জানতে চাইলেন শুধু, ছোটদের না বড়দের। ‘বড়দের জন্যে’, শুনে বললেন, ‘‘আগে তো চায়ের অর্ডারটা দাও, তারপর দেখছি।’’
একসময় ক্যান্টিন থেকে চা এল। পীযূষদার চা-পানও শেষ হল খানিক পরে। ততক্ষণে তাঁর লেখাও হয়ে গিয়েছে আশ্চর্য সুন্দর ছড়াটি।
পিঠকাটা ব্লাউজের গলাকাটা দাম,
পেটখোলা খদ্দের, কাব্যিক গদ্যের
ঢঙে বলে, ‘স্লিভলেসও যদি চাইতাম’,
দোকানি বললে সোজা
‘কাট্টারই মূল্য যা,
কাপড়টা চিরকালই ভারি নিষ্কাম।
জলদগম্ভীর কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন পীযূষদা। তাঁর কণ্ঠস্বর যে কোনও সংবাদপাঠকের কাছেই ঈর্ষণীয় ছিল। অথচ এ ব্যাপারে তিনি আশ্চর্যরকম উদাসীন ছিলেন। খবর পড়তে গিয়ে কত যে মজার কাণ্ড করে ফেলতেন! তখন একটি টেনিস প্রতিযোগিতা চলছে ইংল্যান্ডের সাদাম্পটনে। সে খবরটি পড়ার সময় পীযূষদা বেমালুম বলে গেলেন, ‘‘সাল্ধানাপট্টনমে টেনিস প্রতিযোগিতায় …’’ ইত্যাদি।
খবর পড়ে স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে নিউজরুমে আসতেই সহকারী বার্তা সম্পাদক ‘মেজদা’ জিগ্গেস করলেন, ‘‘ওটা কী পড়লেন? সাদাম্পটনকে করে দিলেন সাল্ধানাপট্টনম?’’
নির্বিকার পীযূষদার ছোট্ট উত্তর, ‘‘জায়গাটার নাম আগে সাল্ধানাপট্টনমই ছিল।’’
আর একটি খবরের কথা। সরকারি ভান্ডারের জন্য তখন রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে ধানসংগ্রহের কাজ চলছে। এর প্রতিদিনের খতিয়ান প্রচার করা হত আকাশবাণী কলকাতার সান্ধ্যকালীন স্থানীয় সংবাদে। সেদিন স্থানীয় সংবাদ পড়ছেন পীযূষদা। পরপর কয়েকটি জেলার নাম ও সেই সঙ্গে ধানসংগ্রহের পরিমাণ বলার পর দিব্যি বলে গেলেন, ‘‘মেদিনীপুর জেল থেকে আজ মোট ১০ হাজার টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে।’’
ব্যস্, এরপর আমাদের সংবাদ বিভাগে ফোন আসতে লাগল একের পর এক— ‘‘কী সব বলছেন আপনারা? জেল থেকেও আজকাল ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে নাকি? ওখানেও ধান চাষ হয়?’’
কিন্তু কী-ই বা করার? হাতের ঢিল আর মুখের কথা, একবার বেরিয়ে গেলে তা কি আর ফেরানো যায়? অবশ্য দুঃখপ্রকাশ একবার করাই যেত ভুল স্বীকার করে। কিন্তু করবেন যিনি, সেই পীযূষদার তো খেয়ালই ছিল না যে, তিনি জেলার বদলে, পড়ে ফেলেছেন জেল। তবে সেদিন নিউজরুমে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হতে পীযূষদা অম্লানবদনে যে কথাটি বলে ছিলেন, তার যেন কোনও মার ছিল না। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আহাম্মকটা ‘ল’-এ ‘আ’-কারটাই যে দেয়নি!’’
এই মানুষটিকেই কিন্তু লেখার সময় দেখেছি কতখানি নিবিষ্ট আর কী অনায়াসেই না চটজলদি লিখে ফেলতেন অনুভবঋদ্ধ বাক্যগুলি! আর একদিনও আবদার করেছিলুম একটি ছড়ার জন্যে। ফেরাননি, লিখে দিয়েছিলেন
‘মাঠে মাঠে তাইচুং, আই. আর. আট
রাখাল Twist নাচে
Transistor বাজে
বাঁশিটা কোথায় আছে থ্যাঁৎলানো কাঠ ।
কদম গাছের গায়
পোস্টারে দেখা যায়
মালা সিন্হা সিনেমায় বড়ো আঁটসাঁট,
স্বাধীনতা এরই নাম
এ জন্যে ক্ষুদিরাম
হাসি হাসি ফাঁসিকাঠে হয়েছে লোপাট।
মনে আছে, সে সময় বাংলায় তাইচুং এবং আই. আর-আট নামে উচ্চফলনশীল জাতের দু’ধরনের ধানের চাষ খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। যা হোক, ছড়াটি সেদিন সহকর্মীদের কাছে আবৃত্তি করেও শুনিয়েছিলাম। সবাই রচনাটির তারিফ করলেও ‘মেজদা’ কিন্তু কোনও উচ্চবাচ্য না করে গম্ভীর মেজাজে কাজ করে গেলেন। কারণটা বোঝা গেল কয়েকদিন পরে।
প্রতিদিনকার মতো সেদিনও ডিকটেশন নেবার জন্যে মেজদার পাশের চেয়ারটায় বসেছি। কাজ শুরু করার আগে তিনি পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে আমাকে দিয়ে চাপা স্বরে বললেন, ‘‘পড়ে দেখ তো, লেখাটা কেমন হয়েছে। মনে মনে পড়বে কিন্তু। কাউকে আবার বোলো না যেন।’’
সেই লেখা পড়ে আমি তো থ। না, থ নয়, দ, ধ, ন— ঠিক কোথায় শ্বাস ফেলেছিলুম মনে নেই। আসলে মেজদার মতো রাশভারী, প্রায়শই খিটখিটে, আপাত নীরস মানুষটির মধ্যে যে অমন অন্তঃসলিলা রসধারা আছে, তা জানাটাই ছিল সেদিন আমার কাছে পরম বিস্ময়ের। একে তো মেজদার কবিতা, তাও আবার চুপিচুপি পড়ার! তিনি লিখেছেন—
স্বপনে দেখিনু হায়
পাশে বসে তুমি নারী,
জাগিয়া দেখিনু হায়
নারী নহ, তুমি ডিক্শনারি।
হ্যাঁ, এ বার বোঝা গেল, কদিন আগে পীযূষদা-র লেখা ছড়াটিকে টেক্কা দিতেই মেজদার এ হেন রচনা। ছোট ছোট মুক্তোদানার মতো এমনই সব টুকরো হাসির দৌলতে কেমন সহজে হালকা হয়ে যেত আমাদের খবরের কাজের চাপ।
আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগে তখন আমাদের ‘বড়দা’ ছিলেন পুলিনবিহারী সান্যাল। তিনি হুগলি জেলার সংবাদদাতা হলেও, একই সঙ্গে মহাকরণের সংবাদও সংগ্রহ করে আনতেন। তাই ছুটির দিন ছাড়া প্রায় রোজই আসতে হত তাঁকে।
বেয়ারা জয়দেবকে ক’দিন আগে পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়েছিল— এ খবরটি বড়দার কানে গিয়েছিল। একটু ক্যাবলা আর খ্যাপাটে গোছের ছিল সেই জয়দেব। সেদিন সে বড়দার টেবিলে চা দিতে গিয়েছে। বড়দা তাকে আস্তে করেই জিগ্গেস, করলেন, ‘‘হ্যাঁরে, তুই নাকি রাজভবনের বাইরের নালাটায় পেচ্ছাপ করতে গিয়েছিলি?’’ শুনেই জয়দেব একেবারে হাঁউমাউ করে উঠে বলল, ‘‘মাইরি বলছি সান্যালবাবু, আমি পেচ্ছাপ করিনি। আমি শুধু পজিশন নিচ্ছিলুম। তা সত্ত্বেও খামোকা পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল।’’ সে যাত্রায় জয়দেবকে একটা রাত হেয়ার স্ট্রিট থানায় আটকে থাকতে হয়েছিল।
আমাদের সংবাদ বিভাগটি কিন্তু সত্যিই ছিল একান্নবর্তী একটি পরিবারের মতো। এই তো সেদিনের কথা। বড়দা তখন লোকান্তরিত। একদিন আমার সহপাঠী ও সহকর্মী গৌতম (বসু) মেজদার উপস্থিতিতেই একটি প্রস্তাব পেশ করল। বলল, ‘‘আচ্ছা, বড়দা তো চলে গেলেন, তা হলে এ বার আমরা তো মেজদাকেই বড়দা বলতে পারি?’’
নিউজরুমে এরপর কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর মেজদা তাঁর অননুকরণীয় বাচনভঙ্গিতে (চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা যেমন) গৌতমের প্রস্তাবটিকে একেবারে ধরাশায়ী করে দিলেন। বললেন, ‘‘বাড়িতে জ্যাঠামশাই মারা গেলে, তোমরা কি বাবাকে জ্যাঠামশাই বলবে নাকি?’’
সবাই চলে গেছেন একে একে, একা একাই, আমাদের সেই সেদিনের একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে।
(লেখক আকাশবাণী ও কলকাতা দূরদর্শনের প্রাক্তন সংবাদপাঠক। মতামত এবং স্মৃতি ব্যক্তিগতে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy