Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
স্বাগতম দাস
Marina Abramovic

ভিড়ের মন বোঝার চেষ্টা

জীবন এবং সম্মান বাজি রেখে এনডিয়োরেন্স আর্ট ফর্ম-এর তুঙ্গ পর্যায়ের এই দৃশ্য সৃষ্টি করছিলেন মারিনা আব্রামোভিচ।

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

১৯৭৪ সালে এক হৈমন্তিক সন্ধ্যা। ইটালির নেপলস শহরে মোররা স্টুডিয়োয় নির্মাণ হচ্ছে এক অতিপ্রাকৃত দৃশ্যের। আলোকিত আর্ট গ্যালারির কেন্দ্রে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন বছর আঠাশের এক মহিলা শিল্পী। তাঁকে ঘিরে একটা ভিড়। সেখানে সমাজের উচ্চকোটির, শিক্ষিত নারীপুরুষ। তাঁরা সামনের টেবিল থেকে তুলে নিচ্ছেন কখনও লিপস্টিক, কখনও ব্লেড বা গোলাপের কাঁটাসমেত ডাল, আর তা প্রয়োগ করে চলেছেন ওই শিল্পীর ওপর। তাঁকে ঘিরে ধরছে অনেক হাত... আর রাত যত গভীর হচ্ছে, হাতগুলো হয়ে উঠছে তত নির্মম।

জীবন এবং সম্মান বাজি রেখে এনডিয়োরেন্স আর্ট ফর্ম-এর তুঙ্গ পর্যায়ের এই দৃশ্য সৃষ্টি করছিলেন মারিনা আব্রামোভিচ। এনডিয়োরেন্স আর্টকে বলা যায় এক ধরনের দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রকাশ্যে অনুষ্ঠেয় শিল্পকৃতি বা পারফর্মিং আর্ট। এতে থাকে না সারা রাত্রিব্যাপী গানের আয়োজন, নাটক বা নৃত্যানুষ্ঠান। শুধু থাকেন এক জিজ্ঞাসু শিল্পী, যিনি কিছু সাধারণ ভাবনাচিন্তার অতীত প্রকরণের সাহায্যে বুঝে নিতে চান যন্ত্রণার স্বরূপ, প্রকাশ করতে চান মানসিক ও শারীরিক সহ্যক্ষমতার ঊর্ধ্বসীমাটি। সেই প্রচেষ্টায় অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীর শরিক হয়ে পড়েন দর্শকেরাও। যেমনটা হয়েছিল মোররা স্টুডিয়োতে। সেই দিনে মারিনা প্রদর্শন করেছিলেন তাঁর সবচেয়ে আলোচিত শিল্পকৃতিটি— ‘রিদম জ়িরো’।

মারিনার বক্তব্য, রিদম জ়িরো-র উদ্দেশ্য ছিল জনতার ভিড়কে বোঝা! কী করতে পারে আর কত দূর যেতে পারে এই ভিড়, যদি সরিয়ে নেওয়া হয় সমস্ত বিধিনিষেধ? প্রদর্শনীর দিন তিনি সম্পূর্ণ গা-ঢাকা পোশাক পরে স্টুডিয়োর একটি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন। সামনের টেবিলে ছিল ৭২টি পরিচিত, কিন্তু পরস্পর সঙ্গতিহীন বস্তু। যেমন— লিপস্টিক, রুটি, গোলাপের কাঁটাওয়ালা ডাল, মধু, ওয়াইন, ধাতব রড, এবং একটি পিস্তল, যার ম্যাগাজ়িনে একটাই বুলেট। আর ছিল মারিনা-র স্বাক্ষরিত অনুমতিপত্র। যাতে বলা ছিল, রাত আটটা থেকে দুটোর মধ্যবর্তী সময়ে সমবেত দর্শকেরা ওই টেবিলে রাখা বস্তুগুলি মারিনার ওপর যদৃচ্ছ প্রয়োগ করতে পারেন।

সে দিন দর্শকমণ্ডলী-র মধ্যে উপস্থিত প্রখ্যাত মার্কিন শিল্প-সমালোচক এবং কবি টমাস ম্যাকভিলেই-এর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, দর্শকেরা প্রথমে মোটামুটি শান্ত ছিলেন। কিন্তু যত সময় এগিয়ে চলে, তাঁদের মধ্যে বইতে থাকে এক চোরাগোপ্তা হিংস্রতার স্রোত। ঘণ্টা তিনেক পরে, কিছু মানুষ কেটে ফেলেন মারিনা-র সমস্ত পোশাক, তাঁর সারা শরীরে লিপস্টিক দিয়ে লেখা হয় যৌন মন্তব্য। মারিনার বিবস্ত্র এবং সম্পূর্ণ অপ্রতিরোধী দেহটি নিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠা ভিড়ে শুধু পুরুষেরাই শামিল হননি, ছিলেন মহিলারাও। টমাস লিখেছেন, চতুর্থ ঘণ্টায় ব্লেডের আঁচড়ে তাঁর শরীরের বহু জায়গা চিরে রক্তাক্ত করা হয়। আর্টফর্মটির প্রতি এক অমানুষিক দায়বদ্ধতা থেকে মারিনা নির্বাক স্ট্যাচুর মতোই সহ্য করতে থাকেন সমস্ত যৌনপ্রহার। কিন্তু তাঁর নীরব অভিব্যক্তি, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল যেন দর্শকদের আরও উত্তেজিত করে তোলে।

ঘণ্টা ছয়েকের প্রদর্শনীটি অবশ্য কোনও ভয়ঙ্কর ঘটনা ছাড়াই শেষ হয়। কারণ, দর্শকদের মধ্যে কিছু মানুষ তখনও নিজেদের মনুষ্যত্ব হারাননি! তাই যখন উন্মত্ত জনতার কেউ এক জন লোডেড পিস্তলটির নল মারিনার গলায় ঠেকিয়ে ট্রিগারে তাঁরই আঙুল জড়িয়ে দেন, তখন ওঠে প্রতিবাদ। কয়েক জন দ্রুত সরিয়ে নেন পিস্তল। রাত দুটোয় ঘোষণা করা হয়, প্রদর্শনীর নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত। দৃশ্যত বিধ্বস্ত মারিনা উঠে দাঁড়ান, সোজা হেঁটে চলেন দর্শকদের মধ্যে দিয়ে। এ বার কিন্তু অন্য দৃশ্য। যত ক্ষণ মারিনা ছিলেন এক প্রতিক্রিয়াহীন লক্ষ্যবস্তু, তত ক্ষণ যাঁরা তাঁর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছিলেন, তাঁরা আর কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না ব্যক্তি মারিনার দিকে, যিনি কিছু ক্ষণের জন্য স্বেচ্ছায় বিসর্জন দেওয়া মানবাধিকারগুলো আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন। শেষে দর্শকেরা প্রায় দৌড়ে পালান ঘরটি ছেড়ে।

সভ্যতার খোলসগুলোকে ছাড়িয়ে ‘রিদম জ়িরো’ প্রায় শক থেরাপি-র ঢঙে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় ফ্রয়েডের ‘টোটেম অ্যান্ড ট্যাবু’ গ্রন্থে বিধৃত মানব মনস্তত্ত্বের সেই ‘অ্যাম্বিভ্যালেন্স’ বা পরস্পর-বিরোধী দু’টি সত্তার সহাবস্থানের সামনে। দেখিয়ে দেয়, যে মুহূর্তে এক জন হারিয়ে ফেলে প্রতিরোধ, সেই মুহূর্তেই পরিচিত লোকগুলোর কাছেও সে হয়ে উঠতে পারে শুধুই এক মানবেতর লক্ষ্যবস্তু, যার ওপরে মিটিয়ে নেওয়া যায় অবচেতনে বাসা-বেঁধে-থাকা আক্রোশ! তখন স্নেহময় পিতা অনায়াসে হয়ে ওঠেন ধর্ষক, অন্তর্মুখী লাজুক কিশোরের হাতে উঠে আসে ইট। অন্তরের এই অন্ধকার বুঝি এমনই সর্বব্যাপ্ত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কত সহজে, খুব তুচ্ছ কিছু অজুহাত সামনে রেখে রাজনীতির কারবারিরা উস্কে দিতে জানে এই অন্ধকারকে। বেধে যায় দাঙ্গা, নেমে আসে অসহায় একের ওপর হিংস্র অনেকের আক্রমণ। এবং— সেই গণহত্যা ও ধর্ষণের রক্ত লেগে থাকে আমাদের সকলের হাতে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট

অন্য বিষয়গুলি:

Marina Abramovic Rhythm 0
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy