হ্যালো, দিলীপবাবু বলছেন! আমি বিজেপিতে যোগ দিতে চাই।’ ক্ষণে ক্ষণেই মোবাইল বেজে উঠছে দিলীপ ঘোষের। বিজেপির রাজ্য সভাপতি এখন সাংসদ। কিন্তু দিল্লিতেও প্রতিনিয়ত তাঁর মোবাইলে রাজ্যের নানা জেলা থেকে ফোন আসছে। বিজেপিতে যোগ দিতে চেয়ে।
লোকসভা ভোটের পর থেকে প্রায় দিনই দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের বিজেপির সদর দফতরে তৃণমূলের কোনও না কোনও নেতা আসছেন। রাতারাতি জার্সি বদলে বিজেপির মঞ্চে অবতীর্ণ হচ্ছেন। তৃণমূলের হাত থেকে বিজেপির দখলে চলে যাচ্ছে একের পর এক পুরসভা, জেলা পরিষদ।
অন্ধ্রেও তেলুগু দেশমের চার রাজ্যসভা সাংসদ বেমালুম বিজেপিতে যোগ দিলেন। রাজ্যসভায় সংখ্যা বাড়াতে নরেন্দ্র মোদী নিজে তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। ভুলে গেলেন, চার জনের মধ্যে দু’জন, ওয়াই এস চৌধুরী ও সি এম রমেশের বাড়িতে ভোটের আগেই সিবিআই-ইডি হানা দিয়েছিল। বেআইনি সম্পত্তি, দুর্নীতির তদন্তে দিনভর তল্লাশি চলেছিল।
বিজেপি নেতারা যুক্তি দিয়েছেন, তল্লাশি হয়েছে বটে। চার্জশিট তো আর জমা পড়েনি। না কি চার্জশিট থেকে বাঁচতেই বিজেপির আশ্রয়ে? সারদা ও নারদ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে তৃণমূলের কিছু বিশিষ্ট নেতা যেমন বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তার পর তাঁদের নাম এখনও চার্জশিটে ওঠেনি। তাঁদের হাত ধরে এখন যাঁরা তৃণমূল ছেড়ে বাংলা থেকে নিয়মিত বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, তাঁরা সবাই কি দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মতাদর্শে দীক্ষিত? এঁদের কারও বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট চালানোর অভিযোগ নেই? কেউ কখনও কাটমানিতে হাত দেননি? প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।
নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, কংগ্রেস-মুক্ত ভারত চাই। ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, কংগ্রেসের সংস্কৃতিতেই দোষ। সেই সংস্কৃতি দূর করতে হবে। কংগ্রেসকেও কংগ্রেসের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে হবে। গত দু’বছরে গুজরাত কংগ্রেসের একের পর এক বিধায়ক, রাজ্যের নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। অনেককেই মন্ত্রিপদ দিয়েছে বিজেপি। মহারাষ্ট্রের বিরোধী দলনেতা লোকসভা ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দিলে, তাঁকেও রাজ্যে মন্ত্রিপদ দেওয়া হয়েছে। অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর বা গোয়ার মতো ছোট ছোট রাজ্যেও বিজেপি কংগ্রেসের বিধায়কদের ভাঙিয়ে এনেছে দল ভাঙন প্রতিরোধ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। কর্নাটকে তো বিজেপির ‘বিধায়ক কেনা’ ঠেকাতে কংগ্রেসকে দলের বিধায়কদের রিসর্টে তালাবন্ধ করতে হয়েছে।
কংগ্রেস-মুক্ত ভারত গড়ার রাস্তা কি তবে কংগ্রেসের নেতাদের ঘরে এনে তোলা? বাংলা থেকে তৃণমূল হটানোর উপায় কি তৃণমূলের নেতাদের বিজেপিতে নিয়ে নেওয়া? দক্ষিণ ভারতে ঘাঁটি গাড়ার কৌশল কি আঞ্চলিক দলগুলির নেতাদের গায়ে বিজেপির গেরুয়া জার্সি পরিয়ে দেওয়া?
কংগ্রেস বরাবরই স্থানীয় জমিদার, মহাজন, বড় ব্যবসায়ী, এলাকার মাতব্বরদের পার্টি। স্বাধীনতার আগে থেকেই এই শ্রেণি কংগ্রেসে। স্বাধীনতার পরে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের প্রাক্তন মহারাজারা কংগ্রেসে নাম লেখাতে শুরু করেন। ইন্দিরা গাঁধীর জমানাতেও সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে। সেই কারণেই কংগ্রেস ভূমি সংস্কারের মতো পুরোপুরি বামপন্থায় চলে যায়নি। আবার উদারবাদী প্রগতিশীল নেহরু-গাঁধী চিন্তাধারার কারণে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরেনি। তা বলে কি কংগ্রেসের অন্দরে ‘নরম হিন্দুত্ব’ ছিল না? ছিল। কংগ্রেসের শিবিরে কি হিন্দুত্ব বা রাম-রাজ্যের স্বপ্নের প্রতি সহানুভূতিশীল নেতা ছিলেন না? ছিলেন। তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার জন্য। নরেন্দ্র মোদী একেই ‘কংগ্রেসি সংস্কৃতি’ বলেন।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বিশ্বাস করত, এই সব স্থানীয় জমিদার-মহাজন-মাতব্বরদের নিয়ে গড়ে ওঠাই কংগ্রেসের প্রধান দুর্বলতা। এতেই ভাঙবে কংগ্রেস। দীনদয়াল উপাধ্যায় জনসঙ্ঘকে মতাদর্শ ও ক্যাডারভিত্তিক দল হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বেনোজল ঢোকানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। তা হলে এখন মোদী-শােহর জমানায় কংগ্রেস, বা কংগ্রেস ভেঙে তৈরি তৃণমূলের নেতাদের স্বাগত জানাতে দ্বিধা নেই কেন?
তিনটি কারণ হতে পারে। এক, মোদী-শাহ আক্ষরিক অর্থেই কংগ্রেস বা বিরোধী-মুক্ত ভারত চান। তাই কংগ্রেস বা তৃণমূল নেতাদের টেনে এনে রাহুল গাঁধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের হতোদ্যম করে দিতে চান। দুই, কংগ্রেস, তৃণমূল বা তেলুগু দেশম থেকে নেতাদের নিয়ে এলেও বিজেপির সংগঠনের রাশ তাঁরা সঙ্ঘ-পরিবারের লোকদের হাতেই রাখছেন। যেমন, দিলীপ ঘোষ। তিন, সংগঠনে কাজ করার লোক থাকলেও বিজেপিতে প্রশাসনিক পদে বসানোর লোকের অভাব। যেমন, বাংলায় বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী কে, লোকসভায় ১৮টি আসন জেতার পরেও তা বড় প্রশ্ন। তাই তৃণমূলের ৪০ জন বিধায়ক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে বড়াই করতেও মোদী দ্বিধা করেন না।
কিন্তু প্রশ্ন একটাই। নরেন্দ্র মোদী দুর্নীতিমুক্ত দল ও প্রশাসনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কংগ্রেসের সংস্কৃতি থেকে সরে আসার প্রয়োজনের কথা বলেছেন। বাংলায় গিয়ে তৃণমূল জমানায় সিন্ডিকেট, কাটমানি সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্ত, সারদা-নারদ কেলেঙ্কারির দিকে আঙুল তুলেছেন। অথচ এত দিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা বাংলায় ঘাঁটি গাড়তে এ সবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নেতাদের দলে টানছেন। বিন্ধ্য পর্বতের অলঙ্ঘনীয় রাজনৈতিক সীমানা টপকে দক্ষিণ ভারতে প্রবেশ করতে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ তকমাওয়ালা নেতাদেরও দলে টানতে দু’বার ভাবছেন না।
বিজেপির মধ্যে কি এ নিয়ে উষ্মা তৈরি হচ্ছে না? হতে বাধ্য। কংগ্রেস-তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে এলাকার মাতব্বররা ভোটের টিকিট পেয়ে বিধায়ক-সাংসদ হয়ে যাচ্ছেন। সারা জীবন সংগঠনে ঘামঝরানো নেতারা পিছনের সারিতেই থেকে যাচ্ছেন। যত দিন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের বিজয়রথের ঘোড়া ছুটবে, এ সব প্রশ্ন উঠবে না। কারণ ২০১৪-র পর ২০১৯-এ নরেন্দ্র মোদী আবার প্রমাণ করেছেন, কে কোথায় প্রার্থী হচ্ছেন, তা তুচ্ছ। তিনিই আসল। মানুষ তাঁকেই ভোট দিচ্ছেন। তিনি প্রচারের সুর ও স্বর বেঁধে দেবেন। বিজেপির আইটি সেল ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে প্রচারে ঢেউ তুলবে। নিচুতলায় বুথকর্মী, পান্না প্রমুখরা পরিশ্রম করবেন। দলের তহবিল থেকে খরচে কোনও কার্পণ্য হবে না। এর ফলে বিজেপিতে দ্বিতীয়, তৃতীয় সারির নেতারা ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছেন। কিন্তু রথের চাকার গতি কমলেই প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসতে কত ক্ষণ!
সে না হয় বিজেপির নিজস্ব মাথাব্যথা। দেশের সংবিধান তো মাথায় রাখা জরুরি। এ বার লোকসভা ভোটে জিতে দেশের সংবিধানের সামনে মাথা নত করেছেন নরেন্দ্র মোদী। সেই সংবিধানের দশম তফসিলেই দল ভাঙানোর সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট নীতি খোদাই করা রয়েছে। নরেন্দ্র মোদী দল ভাঙানো প্রতিরোধ আইনের ফাঁক গলে অন্য দলের সাংসদ-বিধায়কদের বিজেপিতে টেনে আনতেই পারেন। তাতে সংবিধানের মূল নীতিতে আঘাত লাগেই।
আছে বিজেপির দলীয় সংবিধানের প্রশ্নও। দলের মতাদর্শের প্রধান দুই স্তম্ভ ‘হিন্দুত্ব’ ও ‘একাত্ম মানবতাবাদ’। কিন্তু বিজেপির দলীয় সংবিধানের চতুর্থ অনুচ্ছেদ বলছে, দল আর্থ-সামাজিক বিষয়ে গাঁধীবাদী চিন্তাধারা, ইতিবাচক ধর্মনিরপেক্ষতা ও মূল্যবোধ-নির্ভর রাজনীতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে।
কংগ্রেস বা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির টিকিটে জিতে আসা সাংসদরা ইদানীং লোকসভায় গলা ছেড়ে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলছেন। বিজেপির পুরনো সাংসদদেরও ছাপিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নিজের দলকে খাড়া করতে মতাদর্শ বা সততার বাছবিচার না করে অন্য দলের নেতাদের ভাঙিয়ে আনাটা বিজেপির মূল্যবোধ-নির্ভর রাজনীতি কি না, শ্রীরামচন্দ্রের জয়ধ্বনিতে তা আপাতত ধামাচাপা পড়লেও প্রশ্নটা থেকেই যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy