ছবি: সংগৃহীত
গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে যে বিষয়গুলো বিশ্ব জুড়ে আলোচনার শীর্ষে থেকেছে, তার মধ্যে অন্যতম মানুষের হাতে প্রকৃতির নিধন। তা নিয়ে উত্তাল হয়েছে সমস্ত গণমাধ্যম। কিন্তু প্রকৃতিকে বাঁচানো কেন জরুরি? প্রকৃতি রক্ষার আর্জির কারণ কী?
কারণ মূলত দুটো। প্রথমত, মানুষ অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে শুরু করেছে। এত দিন প্রকৃতির স্বাস্থ্যে নজর না দেওয়ায় সে যে শোধ নিতে ছাড়বে না, তার প্রমাণ পেতে শুরু করেছে মানব সভ্যতা। প্রকৃতিকে বাঁচানো নয়, নিজেদের বাঁচাতেই তৎপর হয়েছে মানুষ। দ্বিতীয়ত, প্রকৃতি আসলে মানুষের কাছে বিমূর্ত ভাবনা। সে ভাবনা ‘ইউটোপিয়ান’, সেখানে সমস্ত কিছুই ভাল, সুন্দর, শান্তির। সে ভাবনা মানব মস্তিষ্কে মূর্ত রূপ নেয় শান্ত নদীর পাড়, সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ বা বাতাসে মাথা দোলানো কোনও গাছের ছবি জুড়ে জুড়ে। এই ছবিই যখন ছিঁড়ে যায়, মানুষ অস্তিত্বের সঙ্কটে ভোগে। সেই ছবিকে বাঁচাতেই আন্দোলন গড়ে ওঠে। আসলে নিজেদেরও বাঁচাতে।
ইউটোপিয়ান চরিত্রের প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে এই সম্পর্কের হদিস দিয়েছিলেন যিনি, সেই রিচার্ড হিউ গ্রোভ প্রয়াত হলেন গত ২৫ জুন। বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। গ্রোভ মানবসমাজের জন্য রেখে গিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত থিসিস ‘গ্রিন ইম্পিরিয়ালিজ়ম: কলোনিয়াল এক্সপ্যানশন, ট্রপিক্যাল আইল্যান্ড ইডেনস অ্যান্ড দ্য অরিজিনস অব এনভায়রনমেন্টালিজ়ম, ১৬০০-১৮৬০’ এবং আরও অনেক লেখা। সেই সঙ্গে প্রকৃতিকে বোঝার শিক্ষা। তা বুঝতে শেখায় ঔপনিবেশিক শক্তির বিস্তার এবং দেশজ জ্ঞানের টানাপড়েন। এই টানাপড়েন শতাব্দীপ্রাচীন হলেও বার বার যে তা ফিরে দেখা এবং বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, তা শিখিয়ে দিয়েছেন গ্রোভ। ১৯৯৫ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় গ্রিন ইম্পিরিয়ালিজ়ম। খুলে যায় এনভায়রনমেন্টাল হিস্ট্রি বা প্রকৃতির ইতিহাস চর্চার এক নতুন দিক।
প্রকৃতির ইতিহাস চর্চা নতুন বিষয় নয়। ১৮৬৪ সালে জর্জ পার্কিনস মার্স-এর বিখ্যাত বই ‘ম্যান অ্যান্ড নেচার’-এর হাত ধরেই বিজ্ঞানের ইতিহাসের এই শাখার পথ চলা শুরু। এর পরে এই বিদ্যা চর্চার বিভিন্ন দিক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন ইতিহাসবিদরা। বিশ শতকে ফ্রান্সের অ্যানাল স্কুল উল্লেখযোগ্য। ফেরনান্দ ব্রোদেল লেখেন ভূমধ্যসাগর সংলগ্ন অঞ্চলের ইতিহাস। ইমানুয়েল ল্য রয় লাদুরি তাঁর বই ‘টাইমস অব ফিস্ট, টাইমস অব ফ্যামিন: আ হিস্ট্রি অব ক্লাইমেট সিন্স দ্য ইয়ার ১০০০’-এ লিপিবদ্ধ করেন জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য সঙ্কটের সম্পর্ক। ষাটের দশকের শুরুতে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োগে প্রকৃতি-নিধন বিষয়ে চর্চা তুঙ্গে ওঠে। বাজারে আসে রেচেল কার্সন-এর ক্লাসিক ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’।
এ সমস্ত বিখ্যাত কাজের মধ্যেও গ্রোভ স্বতন্ত্র। এনভায়রনমেন্টাল হিস্ট্রি নয়, তাঁর লেখা ইতিহাসের বিষয় এনভায়রনমেন্টালিজ়ম— প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের ধারণার ও ভাবনার ইতিহাস। তিনি ইতিহাসের অলিগলিতে খুঁজে বেরিয়েছেন প্রকৃতি নামক সেই ইউটোপিয়ান ধারণাকে। মানুষের ভাবনা, ধারণা, উপলব্ধি এবং কয়েক শতাব্দী যাবৎ তার বিবর্তন বুঝতে শুধু অভিলেখাগারের তথ্য নয়, গ্রোভ ডুব দিয়েছিলেন স্বদেশজাত জ্ঞান-সংস্কৃতিতে। তাই নিজের বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন— “এই বই কোনও হিস্টোরিয়োগ্রাফি বা ইতিহাসের পদ্ধতিগত চর্চার মধ্যে পড়ে না। এই বই স্বতন্ত্র।” অবশ্য পুরোটা সত্যি নয়। ১৯৮৩ সালে ‘ম্যান অ্যান্ড দ্য ন্যাচারাল ওয়ার্ল্ড: চেঞ্জিং অ্যাটিটিউড ইন ইংল্যান্ড ১৫০০-১৮০০’ বইয়ে ব্রিটিশ সমাজ প্রকৃতি নিয়ে কী ভাবছে এবং তার বিবর্তনের হদিস দিয়েছিলেন কিথ থমাস। থমাসের কাজকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রোভ।
ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পর ইউরোপের প্রধান দেশগুলিতে প্রকৃতি সম্পর্কে কী ধারণা ছিল, তা দিয়েই গ্রিন ইম্পিরিয়ালিজ়মের সূত্রপাত। শুধুমাত্র ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার নয়, ইডেন নামক ইউটোপিয়ার সন্ধানও একাধিক সমুদ্রযাত্রা এবং নতুন দেশের সন্ধানের নেপথ্যে ছিল। ব্রিটেন-সহ সমগ্র ইউরোপে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ, প্লেগের হানা এবং শিল্প বিপ্লবের চাপ তৈরি করেছিল অস্তিত্বের সঙ্কট, যা স্বপ্নের ইডেনের সন্ধান এবং তাকে বাঁচানোর ইচ্ছেকে পাকাপোক্ত করেছিল। গ্রোভ নজর দিয়েছেন ঔপনিবেশিক ভারত, আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। উপনিবেশে পরিবেশ সংরক্ষণের িপছনে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির অর্থনৈতিক কারণ সন্ধান ইতিহাসবিদদের বেশ পছন্দের বিষয়।
গ্রোভ সে পথে হাঁটেননি। বরং তাঁর লেখায় দ্বীপগুলি যেন এক একটি পরীক্ষাগার, যেখানে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবর্তন, বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে পরিবর্তন এবং শেষ পর্যন্ত সংরক্ষণের ভাবনা হাতে হাত ধরে চলেছে। এই দ্বীপগুলিতেই বটানিক্যাল গার্ডেন গড়ে তোলা এবং চাষের পদ্ধতির পরিবর্তনকে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন হিসেবে দেখাননি গ্রোভ, দেখিয়েছেন দ্বীপগুলির স্বদেশজাত জ্ঞান, ইউরোপীয় প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের টানাপড়েন এবং পরে একসঙ্গে কাজ করার ফসল হিসেবে। গ্রোভের লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে এ সমস্ত বৈজ্ঞানিক অভিযান এবং প্রকৃতিশিক্ষার সমকালীন সাহিত্যে প্রভাব। ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত একাধিক ইউরোপীয় সাহিত্যের উল্লেখ করে তিনি দেখিয়েছেন, কী ভাবে এক দল বিজ্ঞান-উৎসাহীর অভিযান, প্রকৃতি ভাবনা এবং সংগৃহীত জ্ঞান সাহিত্যের হাত ধরে সমাজে প্রভাব ফেলে। প্রকৃতির ইউটোপিয়ান ভাবনা মানব সমাজে জিইয়ে রাখতে সে পদ্ধতি আজও প্রাসঙ্গিক।
বর্তমান বিশ্বে ক্রমশ শহুরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং গ্রামভিত্তিক স্বদেশজাত জ্ঞানের দূরত্ব বাড়ছে। প্রকৃতিকে বুঝতে এবং ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তিনি এই দুই শিক্ষার দূরত্ব কমানোর কথা বলেছিলেন। সেই সঙ্গে সভ্যতাবৃত্তের কেন্দ্রে থাকা মানুষের প্রকৃতি বিষয়ক ভাবনা এবং সংরক্ষণের শিক্ষা যে পরিধির বাইরের দিকে থাকা মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল, তারও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy