মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
এক গভীর লজ্জার সম্মুখে দাঁড় করাইল একটি পত্র। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে লেখা মুসলমান সমাজের বিশিষ্ট জনদের পত্র। সম্প্রতি দুইটি ঘটনায় এমন কিছু লোক যুক্ত ছিল, যাহারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান। পত্রলেখকরা মুখ্যমন্ত্রীর নিকট আবেদন করিয়াছেন, তাহাদের শাস্তি দেওয়া হউক। এবং, যে কোনও ক্ষেত্রেই কোনও মুসলমানের বিরুদ্ধে আইনভঙ্গের অভিযোগ উঠিলে তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হউক— ধর্মীয় পরিচিতির কারণে যেন তাহারা ছাড় না পায়। পত্রটির সম্মুখে দাঁড়াইয়া বৃহত্তর সমাজের— বিশেষত, ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের— মাথা হেঁট হইবার কথা। কোন পরিস্থিতিতে পঞ্চাশ জন সম্মাননীয় নাগরিককে কিছু অপরিচিত অপরাধীর দায় গ্রহণ করিয়া লিখিতে হয় যে তাঁহারা ‘লজ্জিত ও ব্যথিত’! এই সেই ভারত, যাহার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন, দেশে সংখ্যালঘুদের মনে নিরাপত্তার বোধ তৈরি করিবার দায়িত্বটি সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর বর্তায়। এই সেই পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাত দাঙ্গায় আক্রান্ত যুবক যে রাজ্যে ছুটিয়া আসিয়াছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। সেই নিরাপত্তার কতখানি অভাব ঘটিলে এই বিশিষ্ট নাগরিকরা মনে করেন যে তাঁহাদের সমধর্মীয় কতিপয় অপরাধীকে জনসমক্ষে বিচ্ছিন্ন না করিতে পারিলে সেই অপরাধের দায় তাঁহাদের উপরও বর্তাইবে, কথাটি এই দেশ, এই রাজ্য ভাবিয়া দেখিতে পারে। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাঁহারা নিজভূমে পরবাসী হইতে বাধ্য হইয়াছেন। সেই পরবাসে আত্মরক্ষার বিবিধ পন্থা তাঁহাদের খুঁজিয়া লইতে হইতেছে। কখনও জাতীয় পতাকা হাতে ইদের নমাজ পড়িতে যাইতেছেন, কখনও উচ্চৈঃস্বরে ভারতমাতার জয়ধ্বনি দিতেছেন। তাঁহাদের আনুগত্য যে এই দেশের প্রতি, কথাটি প্রতিষ্ঠা করিবার দায় ভারতীয় রাজনীতি শেষ অবধি তাঁহাদের স্কন্ধেই চাপাইয়া দিল। ভারত নামক ধারণাটির এত বড় অপমান বিরল।
নরেন্দ্র মোদী সম্ভবত পত্রটি পড়েন নাই। কিন্তু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কি এই পত্রটির মর্ম বুঝিয়াছেন? টের পাইয়াছেন, এই পরিস্থিতির পিছনে তাঁহার দায় কতখানি? বেয়াদব বাইকচালক যদি মুসলমান হয়, পুলিশ তাহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে না— কলিকাতার যে কোনও রাস্তায় কান পাতিলেই এই অভিযোগ শোনা যাইবে। তাহার পিছনে কোনও প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক নির্দেশ আছে কি না, জানিবার উপায় রাজ্যবাসীর নাই। তাঁহারা অনুমান করিয়া লহেন। কিন্তু, সেই অনুমান কেন সর্বদাই তোষণের দিকে নির্দেশ করে? তাহার কারণ, মুখ্যমন্ত্রী তেমন ধারণাই গড়িয়া দিয়াছেন। ইমাম ভাতা ব্যতিরেকে প্রশাসনিক তোষণের কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ অভিযোগকারীদের হাতে নাই— কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রীর মুখনিঃসৃত বাণী আছে। মুসলমান সমাজকে ‘দুধ দেওয়া গরু’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়া তিনি সেই সমাজের উপকার করেন নাই। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে মানুষের মনে সংশয় তৈরি করিয়া দিয়াছেন। সংখ্যালঘুদের পার্শ্বে দাঁড়াইবার কথাটি তিনি যখন বারংবার বলেন, ধরা যাইতে পারে, তাহা শুধু রাজনীতির খাতিরে নহে, প্রকৃত সদিচ্ছাপ্রসূত। বস্তুত, শাসকের সেই সদিচ্ছা থাকা অতি জরুরি। কিন্তু, তিনি বুঝেন নাই— তাঁহাকে কেহ বুঝাইয়া বলিবার সাহস করেন নাই— মুসলমানদের পার্শ্বে দাঁড়াইবার চেষ্টায় তিনি যে কাজগুলি করেন, এবং বিশেষত যে কথাগুলি বলেন, তাহা হিন্দুত্ববাদীদের সুযোগ করিয়া দিতেছে। হিন্দুত্ববাদীরা সেই সংশয়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিতেছে আপাতত। মুসলমান মাত্রেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-আশ্রিত অপরাধী, এমন একটি মারাত্মক অন্যায় কথা বলিবার সুযোগ পাইতেছে তাহারা, এবং রাজ্যের অনেক মানুষের নিকট সেই কথা বিশ্বাসযোগ্যও ঠেকিতেছে। পরিণতি— মুসলমান সমাজের বিশিষ্ট মানুষদের পত্র লিখিয়া প্রমাণ করিতে হইতেছে, তাঁহারা তোষণ চাহেন না, আইনের শাসন চাহেন। পশ্চিমবঙ্গ এই লজ্জা কোথায় রাখিবে?
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy