ছবি: পিটিআই
অভিযোগটা কিন্তু সাংঘাতিক! চুরি। ইয়েস বস, কুম্ভীলকবৃত্তি, যাকে রকের ভাষায় ‘টুকলি’ বা ‘ঝেড়ে দেওয়া’ বা ‘ঝেঁপে দেওয়া’ বলে, তা তো চুরি-ই। স্বামীজির লব্জ ধার করে একটু ভদ্রস্থ ভাবে বলা যায়—ভাবের ঘরে চুরি। কিন্তু তাতে মহাবিদ্যার জৌলুস কিছুমাত্র কমে না। ‘ভাব’ নামক বস্তুটি তাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। এহেন অভিযোগ উঠেছে যাঁর বিরুদ্ধে, তিনি বলিউডের সুরকার বা বাংলা ব্যান্ডের লিরিসিস্ট নন, তিনি এক সাংসদ। আপাতত মহুয়া মৈত্র এক বেসরকারি চ্যানেলের আনা কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগের কারণে সংবাদ শিরোনামে। অবশ্য, মহুয়া মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং হয়েছেন কিছু দিন আগেই। লোকসভায় তাঁর প্রথম ভাষণেই সারা দেশের নজর কাড়েন কৃষ্ণনগর থেকে নির্বাচিত এই তৃণমূল সাংসদ। সোশ্যাল মিডিয়ায় মহুয়া হয়ে ওঠেন আলোচ্য বিষয়। তাঁর সেই বক্তৃতার ভিডিও ভাইরাল হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে দেখা দিতে থাকে প্রতিক্রিয়া। মহুয়ার বিরুদ্ধে আনা কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগকে সেদিক থেকে দেখলে এই ‘ট্রেন্ড’-এর এক পরিণতি বলে মনে হতেই পারে।
কী বলেছিলেন মহুয়া তাঁর ‘মেডেন স্পিচ’-এ? মহুয়া বর্তমান শাসক পক্ষের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন সাতটি লক্ষণ, যা তাঁর মতে এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতিতে খুল্লমখুল্লা ভাবে দৃশ্যমান। এই লক্ষণগুলো ফ্যাসিজমের জাগরণের। মহুয়ার মতে, যা বর্তমান সরকারের মধ্যে অতি স্পষ্ট ভাবে দেখা দিয়েছে। মহুয়া একে একে স্পষ্ট ভাষায় সেই লক্ষণগুলোকে তুলে ধরেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাহবার পাশাপাশি মহুয়াকে নিয়ে কছু বাঁকা কথাও যে কিচমিচ করছিলনা, এমন নয়। কিন্তু এক সর্বভারতীয় চ্যানেল-কর্তা অভিযোগ আনলেন যে, মহুয়ার এই ‘সাত লক্ষণ’ আসলে ‘টুকলি’, মার্কিন অ্যানালিস্ট মার্টিন লংম্যানের একটি নিবন্ধ থেকে সরাসরি ‘ঝেড়ে দেওয়া’, তখনই বাধল ধামাল। মহুয়াকে তাঁর সদ্য অর্জিত গুরুত্ব থেকে টেনে নামানোর একটা বিরাট সুযোগ পেয়ে গেলেন ফেসবুক-টুইটারের বক্তিয়াররা। ব্যাপারটা এমন দিকে গড়াতে লাগল যে, মহুয়ার বক্তব্য নয়, তাঁর ‘টুকলি’-ই মুখ্য। ফ্যাসিজম ভেসে গেল অলকানন্দা জলে।
সেই ধামালের প্রকৃতি বোঝার আগে তাই একবার মহুয়া কর্তৃক তুলে ধরা সেই লক্ষণের তালিকায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
১) উগ্র, উদগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান। দেশের মধ্যেই এই জাতীয়তার এক বিরোধীপক্ষকে খুঁজে নিয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করার প্রবল প্রচেষ্টা।
২) মানবাধিকারের যথেচ্ছ লঙ্ঘন। মহুয়া উদাহরণ হিসেবে ‘হেট ক্রাইম’-এর সাম্প্রতিক উন্মার্গগামী বৃদ্ধির কথা বলেছিলেন।
৩) গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উদ্বায়ীভবন। এবং মিডিয়ার উপরে শাসকের পূর্ণ দখলদারি। আলোচ্য সময়কালে ফেক নিউজ-এর রমরমা।
৪) জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে অসম্ভব রকমের বাড়াবাড়ি। দ্রুত শত্রু চিহ্নিতকরণের জন্য প্রবল তৎপরতা।
৫) ধর্মের সঙ্গে সরকারের গাঁটছড়া।
৬) বৌদ্ধিক কর্মকাণ্ড ও শিল্প-সাহিত্যের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের চূড়ান্ত অবহেলা।
৭) নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে মারাত্মক ক্ষয়।
পরে এক টুইটে মহুয়া জানান তাঁর চিন্তাসূত্রের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম-এ রক্ষিত এক পোস্টারের কথা তিনি বলেন, যেখানে ফ্যাসিবাদের উত্থানের আরও কিছু লক্ষণের কথা লেখা রয়েছে বলে তিনি জানান।
আরও পড়ুন: চিকিৎসা সঙ্কট
যে বেসরকারি মিডিয়া মহুয়ার বিরুদ্ধে কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ এনেছে, তাদের দাবি, ফ্যাসিবাদের ১২টি লক্ষণের কথা মার্টিন লংম্যান লিখেছিলেন এবং মহুয়া সেটি বেমালুম ‘ঝেড়ে দেন’। অতএব রবীন্দ্রনাথ বিরচিত ‘শ্যামা’ গীতিনাট্যের একটি বিশেষ গান (‘ঐ চোর ঐ চোর’) ধ্বনিত হতে লাগল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ রাজ্যের রাজনীতির পালে সদ্য লাগা গেরুয়া বাতাসে ইন্ধন প্রদানকারীরা মার মার রবে ফেসবুক ফাটাতে লাগলেন। ট্রোলের বন্যা বইতে লাগল।
কিন্তু এ কথা কেউই ভেবে দেখলেন না, মহুয়া একবারও তাঁর সূত্রকে অস্বীকার করেননি। মার্কিন হলোকাস্ট মিউজিয়ামের পোস্টারটির কথা তিনি অতি অবশ্যই স্বীকার করেছেন সংসদে তাঁর প্রথম দিনের বক্তব্যে এবং পরে টুইটেও। ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি মার্টিন লংম্যান ওই পোস্টারটিকে তুলে এনেই তাঁর নিবন্ধ ‘দ্য টুয়েলভ আর্লি ওয়ার্নিং সাইনস অব ফ্যাসিজম’ লিখেছিলেন ‘ওয়াশিংটন মান্থলি’-তে। লংম্যানের উদ্দেশ্য ছিল, পোস্টারে উল্লিখিত ওই ১২টি লক্ষণের সঙ্গে ট্রাম্প-শাসনকে মিলিয়ে দেখা এবং মার্কিন মুলুকে এই শাসন যে ফ্যাসিবাদের এক নয়া অধ্যায় রচনা করতে চলেছে, তা খোলাখুলি তুলে ধরা। সে হিসেবে দেখলে লংম্যানও এই লক্ষণগুলিকে ‘কোট’ করেছিলেন। তাঁর নিবন্ধে পোস্টারটির ছবি জ্বলজ্বল করছিল বেসরকারি ওই চ্যানেলের দাবি, মহুয়া নাকি ট্রাম্পের জায়গায় খালি ‘মোদী’ শব্দটা বসিয়েছেন। ফলে এটা নিছক কুম্ভীলকবৃত্তি।
আরও পড়ুন: অচল পঞ্চায়েত
এখন কোনও কিছু উদ্ধৃত করা কি তাকে ‘আত্মসাৎ’ করা? সাইটেশন যে কোনও বিদ্যাচর্চাতেই একটা ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপার। সাইটেশন যদি কুম্ভীলকবৃত্তি হয়ে থাকে, তা হলে বাংলার তাবড় সব রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সকলেই কুম্ভীলক। কারণ, তাঁরা সারা জীবন রবীন্দ্রনাথ থেকে ‘ঝেঁপে’ই চালিয়েছেন। বিশ্বসুদ্ধ ইতিহাসবিদেরা সবাই কুম্ভীলক, কারণ ইতিহাস নামক ডিসিপ্লিনটি দাঁড়িয়েই রয়েছে আপ্ত-প্রমাণের উপরে। দার্শনিকরাও সবাই কুম্ভীলক, কারণ তাঁরা পূর্বসূরীদের উক্তির উপরেই দাঁড়িয়ে থাকেন। ফলে, যে কেতায় ১৯৭৮ সালে ব্রিটিশ পপ সঙ্গীতগোষ্ঠী ‘বাগ্লস’-এর গাওয়া ‘ভিডিও কিলড দ্য রেডিও স্টার’ গানটি ১৯৮২ সালের বলিউডি ছবি ‘ডিস্কো ডান্সার’-এর ‘কোই ইঁয়াহা আহা নাচে নাচে’-তে রূপান্তরিত হয়েছিল, মার্কিন হলোকাস্ট মিউজিয়ামের সেই পোস্টার সেই কেতাতে মহুয়ার স্পিচে পরিণতি যে পায়নি, তা সদ্য গোঁফ ওঠা ভারতীয়রাও মানবেন। কিন্তু দেশের এক জনপ্রিয় মিডিয়াকে কীসে কামড়াল যে এমন শিশুসুলভ এক অভিযোগ তারা মহুয়ার বিরুদ্ধে আনল? প্রসঙ্গত মার্টিন লংম্যানও জানিয়েছেন, তাঁর রচনা থেকে কোনও অংশই মহুয়া ‘ঝেড়ে দেননি’। বরং তাঁর টুইটে লংম্যান ভারতীয় চরম দক্ষিণবাদীদের সম্পর্কে এক জুৎসই মার্কিন খিস্তি উপহার দিয়েছেন।
ভারতীয় মিডিয়ার এই আচরণ আপাতদৃষ্টিতে উৎপটাং বলে মনে হলেও আদপে তা নয়। মহুয়ার স্পিচেই এর উত্তর রয়েছে। তাঁর উল্লিখিত তিন নম্বর লক্ষণটিকেই প্রমাণ করে এই অভিযোগ। কিন্তু কেন? এখানে আর এক প্রস্থ খেলা রয়েছে। ইন্টারনেটে ফ্যাক্ট চেকিং-ওয়ালারা জানান, হলোকাস্ট মিউজয়ামে নাকি এমন কোনও পোস্টার প্রদর্শিত নয়। ওই পোস্টারটি সেই মিউজিয়ামের স্যুভেনির শপ-এ কিনতে পাওয়া যায়। তা-ই যদি হয়, মহুয়ার অন্যায়টা কোথায়?তিনি মিউজিয়ামের কথা বলে, পোস্টারের কথা বলে, তাতে উল্লিখিত আরও কিছু লক্ষণের কথা বলে তাঁর বক্তব্যকে শেষ করেছিলেন। না। মহুয়ার দোষ ছিল। তিনি ওই পোস্টারে উল্লিখিত একটি লক্ষণের কথা বলেননি। ওই ১২টির তালিকায় ৫ নম্বরটি ছিল ‘র্যাম্পান্ট সেক্সিজম’। হ্যাঁ। প্রবল লিঙ্গবৈষম্য ফ্যাসিবাদের এক অতি আবদেরে লক্ষণ। তা আমরা হিটলারে দেখেছি, মুসোলিনিতে দেখেছি, স্তালিনেও দেখেছি, ট্রাম্পেও দেখছি। মহুয়া একজন নারী বলেই কি তাঁকে আক্রমণ? আর আক্রমণ করতে হবে বলেই কি আক্রমণ? সেই কবে থেকে এদেশের উগ্র জাতীয়তাবাদের নাভিবিন্দুতে অবস্থানরত একতরফা ও আখাম্বা পৌরুষের কথা বলে আসছেন আশিস নন্দী! সেই পৌরুষ যদি রূপান্তর পেতে পেতে বজরঙ্গবলী আর তাঁর গদায় পরিণত হয়ে থাকে, তা হলে তাকে কি খুলে বলা যাবে না? না মহুয়া, আপনিও এই ‘সেক্সিজম’-এর পয়েন্টটা তোলেননি। কিন্তু শাসক পক্ষের বকলম মিডিয়া ওই বারোটি লক্ষণের তালিকা থেকে একটিকে নিজেই নিয়ে এল। অলজ্জের মতো তা মেলে ধরল জনসমক্ষে। ভরা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এক নিউ কিড ইন দ্য ব্লকের কাছ থেকে এক দীপ্ত ও দৃপ্ত উচ্চারণকে দমিয়ে রাখাই ছিল কি এই অভিযোগের উদ্দেশ্য? আর সেই ‘কিড’-টি যদি নারী হয়ে থাকেন,তাহলে তার দমন আশু কর্তব্য?
না, মমতা বা মায়াবতী হলে এমনটা হত না। এমনটা হত না কারণ মমতা বা অন্য কেউ এই স্পিচটাই দিতেন না। তাঁদের অন্য কাজ। সেই কাজের ব্যাকরণের সঙ্গে পার্লামেন্ট, শাসক, স্পিকার, বিরোধীপক্ষ—সব্বাই পরিচিত। কিন্তু, মহুয়ার মেডেন স্পিচটি ভারতী সংসদে এক বিরল ঘটনা। পশ্চিম গোলার্ধেও যে ফ্যাসিবাদের নয়া নামাবলি বোনার কাজ চলছে, এটা যেমন তিনি মনে করিয়েছেন হলোকাস্ট মিউজিয়ামের কথা বলে, তেমনই এদেশীয় রাজনীতির এক রামধনু তুলে এনে তাকে পাবলিকের সামনে তুলে ধরে বলতে চেয়েছেন—এই নাও। একটু মাথার ব্যায়াম করে মিলিয়ে নাও গত কয়েক বছরে ভারতে ঘটে চলা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে। ভাবো। ভাবা প্র্যাকটিস করো।
মহুয়ার এই ‘তোমাকে ভাবাবোই’ নীতিতে কি সেঁকে গেল মসনদ? চেনা ইডিয়মের বিরোধিতার চৌহদ্দির বাইরে অবস্থিত এই স্পিচ কি ঘেঁটে দিল শাসকের ঘিলু? তাই বুঝি নেমে আসে নিদানের খাঁড়া? আসলে ফ্যাসিবাদের আরও কিছু লক্ষণ রয়েছে। সেটা ওই পোস্টারও বলেনি। ফ্যাসিবাদের অন্যতম লক্ষণ হল ভিন্নপক্ষের ভয়ে, ভিন্ন মতের ভয়ে যত্রতত্র জুজু দর্শন। সেটা ইতালীয় পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনি দেখিয়েছেন তাঁর ‘অ্যামারকর্ড’ (১৯৭৩)-এ। উমবের্তো একো দেখিয়েছেন তাঁর একাধিক উপন্যাসে। ভারতে এই জুজু-দর্শনের এক বড় উদাহরণ হয়ে থাকল মহুয়ার ঘটনা। কিন্তু এই ফাঁকে উঁকি দিয়ে গেল আর একটা স্মৃতি। ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘হে রাম’-এর একটি দৃশ্যে পরিচালক কমল হাসান অ্যানিমেশন মারফত এক স্বস্তিকা চিহ্নকে পদ্মফুলে রূপান্তরিত হতে দেখিয়েছিলেন। সেই সময়ে বা তার পরে ওই ব্যাপারটা নিয়ে কেউ বড় একটা কথা তোলেননি। হয়তো কমল পুরুষ বলে। হয়তো তাঁর চিরকালীন বেখাপ্পা অবস্থানের কারণে তাঁকে না ঘাঁটাতে চেয়ে। কিন্তু সেলুলয়েডে ওই দৃশ্যটা যে থেকে গেল শাসক মশাই? মহুয়ার মুখ বন্ধ করতে গেলে যদি কুম্ভীলকবৃত্তির ঝান্ডা খাড়া করতে হয়, তাহলে ‘হে রাম’ থেকে ওই দৃশ্যটা যে কেটে বাদ দিতে হবে? না হলে লোকে নিন্দে করবে যে! লোকে ভাবতে শুরু করে ফেলবে যে!
পুনশ্চ: সাম্প্রতিকতম খবর— ওই চ্যানেল ও তার কর্তার বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিস এনেছেন মহুয়া।
আর আলোচনা নয়। আরও হতে থাকলে লোকে ভেবে ফেলবে যে! সে বড় অশৈল কাণ্ড। সে সব হতে দেওয়া যায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy