প্রয়াত সিপিআই নেতা ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের নির্বাচনী প্রচারের একটি আখ্যান প্রবাদতুল্য হইতে পারিত। অথচ, এখন তাহা বিস্মৃতপ্রায়। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে তিনি বসিরহাট কেন্দ্রে লোকসভা প্রার্থী। প্রথম বার সেই কেন্দ্রে ভোটে দাঁড়াইয়াছেন। নির্বাচনী প্রচারে তিনি বলিলেন, আপনারা যদি রাস্তাঘাট, জলের সমস্যা ইত্যাদির সমাধান করিব ভাবিয়া আমায় ভোট দিতে চাহেন, তবে দিবেন না। ওইগুলি সাংসদের কাজ নহে। সেই দায়িত্ব পুরপিতার, বিধায়কের। যদি চাহেন যে দেশের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে আমার ভূমিকা থাকুক, তবেই আমায় ভোট দিবেন। ইন্দ্রজিৎবাবু নির্বাচনে জিতিয়াছিলেন। আখ্যানটি কেন বিস্মৃতপ্রায়, লোকসভায় দিলীপ ঘোষদের দেখিলে তাহার আঁচ পাওয়া সম্ভব।
নীতিনির্ধারণের, জাতীয় বিতর্কের সর্বোচ্চ পরিসরটিকে তাঁহারা বঙ্গীয় রাজনীতির আখড়ায় পরিণত করিতেছেন। শুধু দিলীপবাবুদের দিকে আঙুল তুলিলে অন্যায় হইবে— এখন সব দল হইতেই যাঁহারা নির্বাচিত হইয়া সংসদে যান, তাঁহাদের কত জনের আগ্রহ থাকে ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠিয়া প্রকৃত প্রশ্ন উত্থাপনের? সুখের কথা, এ বারের অধিবেশন শুরু হইতেই পশ্চিমবঙ্গের দুই সাংসদ ব্যতিক্রমী হইলেন। দুইটি পৃথক অর্থে, প্রথম সুযোগেই। প্রথম জন দীর্ঘ দিনের সাংসদ, এই দফায় কংগ্রেসের সংসদীয় দলনেতা অধীর চৌধুরী। অন্য জন মহুয়া মৈত্র, প্রথম বারের তৃণমূল সাংসদ। দলনেতা হিসাবে, এবং সাংসদ হিসাবে, তাঁহাদের প্রথম ভাষণেই ছাপ রাখিলেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের দুই বঙ্গীয় রাজনীতিক। একাধিক কারণে ইহা তাৎপর্যপূর্ণ। এক, তাঁহারা ক্ষুদ্র রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠিয়াছেন, বঙ্গীয় রাজনীতির তরজাকে সংসদের পরিসরে লইয়া আসেন নাই; দুই, নিজেদের পূর্বপ্রস্তুতি উভয়ের ভাষণেই স্পষ্ট; তিন, ভারত নামক ধারণাটির প্রাণকেন্দ্রে যে দর্শন, দুই জনের ভাষণই সেই সুরে বাঁধা ছিল।
ইতিহাস বলিবে, এই বাংলার বাগ্মী সাংসদ বড় কম ছিলেন না। শরৎচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হইতে হীরেন মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়— বহু বঙ্গজ রাজনীতিকই সংসদে বাগ্মিতায়, পাণ্ডিত্যে, প্রস্তুতিতে এবং ভারতের মূলগত চরিত্রের প্রতি দায়বদ্ধতায় নিজেদের নাম উজ্জ্বল করিয়াছেন। সাম্প্রতিক কালের উল্লেখযোগ্য নাম— সুগত বসু। এখনই এই মহারথীদের সারণিতে অধীর চৌধুরী বা মহুয়া মৈত্রকে বসাইবার প্রশ্ন উঠে না। কিন্তু, যে সংসদ ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়ার, অথবা ক্ষুদ্র তরজা করিবার জায়গা হইয়া উঠিতেছে, সেই সংসদীয় পরিসরের মূল চাহিদাটি যে আসলে মননশীল বক্তব্য ও বিতর্ক, এই কথাটি তাঁহারা ফের স্মরণ করাইয়া দিলেন। না, তাঁহাদের ভাষণ দল-নিরপেক্ষ ছিল না। তাহা হইবার কারণও নাই— রাজনীতি নিরালম্ব হইতে পারে না। নিজস্ব দলীয় অবস্থান হইতেই বর্তমান শাসকদের বিপজ্জনক রূপটির কথা তাঁহারা স্মরণ করাইতেছিলেন। নরেন্দ্র মোদীদের শাসনে সত্যই ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শোনা যাইতেছে কি না, তাহা তর্কসাপেক্ষ। সংসদ এই তর্কেরই পরিসর। একমাত্র এই তর্কের মাধ্যমে, গ্রহিষ্ণু বিরোধিতার পথেই গণতন্ত্র অগ্রসর হইতে পারে। বিরোধীদের সমালোচনা হইতেই শাসকরা নিজেদের ভুলগুলি দেখিয়া লইতে পারেন। কিন্তু, তাহার আর একটি পূর্বশর্ত আছে— শাসক পক্ষকে মনোযোগী শ্রোতা হইতে হইবে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও জওহরলাল নেহরু যে মনোযোগের সঙ্গে বিরোধী নেতাদের ভাষণ শুনিতেন, তাঁহাদের নির্ভয়ে বিরোধিতা করিবার সাহস দিতেন, ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে তাহা কিংবদন্তি। অন্য কোনও নেতার উদাহরণের প্রয়োজন নাই, স্বয়ং অটলবিহারী বাজপেয়ীই নেহরুর এই রূপটির সাক্ষী ছিলেন। প্রশ্ন হইল, এখনকার শাসক কি শুনিতে প্রস্তুত? অধীর-মহুয়ারা যদি নিজেদের ভাষণকে সেই স্তরে উত্তীর্ণ করিতে পারেন, যেখানে শাসক পক্ষ তাঁহাদের সমালোচনা শুনিতে বাধ্য হইবেন, তাহাই হইবে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ জয়।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy