প্রতীকী ছবি।
সাতাশি বৎসরের ইতিহাসবিদের বিদ্রুপের দাপটে মহাপরাক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়তম প্রকল্পটিকে সম্প্রতি বড়ই করুণ দেখাইতেছে। যদিও নরেন্দ্র মোদী বলিয়াছেন তাঁহার ‘স্বচ্ছ ভারত’ বিশ্বদরবারে আজকাল নাকি বিপুল প্রশংসিত হইতেছে, কিন্তু ইরফান হাবিবের বিদ্রুপটি যে যথার্থ ও সুপ্রযুক্ত, মোদীভক্তরাও কি জনান্তিকে তাহা স্বীকার করিবেন না? গাঁধীর দেড়শত বৎসরের উদ্যাপনে বরেণ্য ইতিহাসবিদের মন্তব্য: ভারতীয় জনতা পার্টির সৌজন্যে মহাত্মা গাঁধী আজকাল ‘সিনিয়র স্যানিটারি ইনস্পেকটর’-এ পর্যবসিত হইয়াছেন। বাস্তবিক, ‘স্বচ্ছ ভারত’ বিষয়ে বিজেপির ধারণাটিকে গত চার বৎসর ধরিয়া যে ভাবে গাঁধীর মোড়কে পরিবেশন করা হইতেছে, গাঁধীর বক্তব্যকে অতিসরলীকৃত করিয়া তাঁহাকে রাজনৈতিক ভাবে আত্মস্থ করিবার চেষ্টা চলিয়াছে, তাহা এক কথায় নিদারুণ। নিকাশি ব্যবস্থা একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়, স্বাধীনতার সাত দশক পরেও দেশের শৌচালয় সমস্যা একটি বৃহৎ সঙ্কট, এ সবই ঠিক। কিন্তু গাঁধীর ভাবনায় নিকাশি ও শৌচালয় দারিদ্র ও বৈষম্যের সহিত সম্পর্কিত ছিল। ভারতের ত্রুটিযুক্ত নগরসভ্যতার চরিত্রলক্ষণ, এবং গ্রামীণ ভারতের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি না দিবার ফল ছিল। ঘরে ঘরে শৌচালয় গাঁধীকে নিশ্চয় খুশি করিত, কিন্তু তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি কিছু তিনি চাহিয়াছিলেন। বিজেপির কর্মকাণ্ড তাঁহার সেই বৃহত্তর দৃষ্টিটি মুছিয়া দিয়া যেটুকু রাখিয়াছে, তাহাকে শৌচালয় পরিদর্শকের ভূমিকা বলিলে মোটেই ভুল হয় না।
দেশ-বিদেশে স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প যতই প্রশংসা পাক, প্রধানমন্ত্রীকে মনে করাইয়া দেওয়া কর্তব্য যে প্রকল্পের প্রশংসার কৃতিত্ব বহন করিবার সঙ্গে ‘স্বচ্ছতা’ কিংবা পরিচ্ছন্নতা বিষয়টিকে এতখানি সঙ্কীর্ণ করিয়া ফেলিবার দায়টিও তাঁহাকেই বহন করিতে হইবে। শৌচালয়ের অভাবে যে ধরনের সঙ্কট দেখা দেয়, গ্রামাঞ্চলে এবং শহরাঞ্চলে স্তূপীকৃত আবর্জনাও সেই একই সঙ্কট তৈরি করিতে পারে। অথচ এই দিকে প্রকল্পের দৃষ্টি নাই। আর একটি অতি অবহেলিত বিষয়— জলদূষণ। কেবল পুকুর-বিলের যে জল সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহারে লাগে, তাহা নয়, নদীর দূষণও এ দেশে একটি ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছে। যত দূর নাগরিক স্মরণ করিতে পারেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসিয়াই গঙ্গাদূষণ প্রতিরোধ এবং সংস্কারকে বিরাট গুরুত্ব দিয়া বিবেচনা করিয়াছিল। আর একটি ভোট আসিতে চলিল, কিন্তু গর্জনের তুল্য বর্ষণ দেখা গেল না।
ইরফান হাবিবের মন্তব্যটি অবশ্য স্বচ্ছতার বাহিরেও একটি গুরুতর কথা বলে। গাঁধীজিকে এই সরকার যে ভাবে চশমা, চরকা ইত্যাদি প্রতীকের মাধ্যমে সহজপাচ্য করিয়া, নিজের প্রয়োজনমতো রূপ সেই প্রতীকে বসাইয়া আত্মসাৎ করিতেছে, তাহা শুধু ছেলেমানুষি বাড়াবাড়ি নয়, তাহার মধ্যে একটি বিপজ্জনক রাজনীতি আছে। গাঁধী সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু ইত্যাদির বাহিরে গিয়া ভারতের মানুষকে ভাবিতে পারিয়াছিলেন, নিম্নশ্রেণি নিম্নবর্ণ ইত্যাদি উপেক্ষা করিয়া অবহেলিত ভারতের পাশে গিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। বর্তমান বিজেপি সরকার কোনও মতে তাহার উত্তরাধিকার দাবি করিতে পারে না। তাহাদের গাঁধী-ভক্তির মধ্যে তাই শঠতার পরিমাণটি দৃষ্টিকটু রকমের বেশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy