ব্যবধান: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৩ জানুয়ারি, ২০২১। পিটিআই
আজ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থাকলে হয়তো নতুন শব্দবন্ধে বলতেন, ‘হায় নেতাজি, তোমার দিন গিয়াছে!’ সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সূচনাপর্বে যা দেখা গেল, তাতে এমন মনে হওয়া স্বাভাবিক। তাঁকে নিয়ে এ বারের এত আয়োজন, এত কলরবের আড়াল থেকে আসলে বাংলার আসন্ন নির্বাচন যে উঁকি দিচ্ছে, সেই সত্য না মানলে মিথ্যাচার হবে। বাংলা ও বাঙালির আবেগের অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি জায়গাকে এই ভাবে কুৎসিত রাজনীতির কবলে পড়তে দেখা দুর্ভাগ্যের।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আয়োজিত অনুষ্ঠান ছিল আমন্ত্রণমূলক। সেখানে ‘জয় শ্রীরাম’ বাহিনী কারা, কী উদ্দেশ্যে ঢোকাল, কেন ঠিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতার সময়টুকু বেছে নিয়েই তাঁরা তারস্বরে স্লোগান দিতে আরম্ভ করলেন, এই সব আলোচনা এখন জোরদার। অনেকেরই মনে আছে, বছর তিনেক আগে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর সমাবর্তনস্থলেও এই রকম সংগঠিত ‘শ্রীরাম’ নিনাদ অনুষ্ঠানের ছন্দপতন ঘটিয়ে পার পেয়েছিল। সুতরাং এই ধরনের সংস্কৃতিতে অভ্যস্তদের কাছে এটা অনভিপ্রেত আচরণ বলে গণ্য না-ই হতে পারে, তাঁদের মিত্র-পৃষ্ঠপোষকেরাও যে এতে খুশি হবেন, সে কথা বলা বাহুল্য।
তবু যা অবাক করে এবং প্রশ্ন জাগায় তা হল, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর শীতল প্রতিক্রিয়া। সব দেখে, সব বুঝে তাঁর মুখ ফিরিয়ে থাকা। শান্তিনিকেতনেও সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সময় উৎসাহী ‘রাম’-ভক্তদের তিনি নিরস্ত করেননি। সেটা অবশ্য ছিল তাঁর প্রতি সমর্থনের উল্লাস।
আর এ বার যা হল, তা প্রধানমন্ত্রীকে সাক্ষী রেখে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি মুখ্যমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে কার্যত হেনস্থা করা। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ-বিবাদের অনেক ঊর্ধ্বে। এই ঘটনা দুই শীর্ষস্থানীয় সাংবিধানিক পদের নিরিখে বিচার্য। অথচ প্রধানমন্ত্রী এক বার হাত তুলেও ওই অভব্যদের সংযত হতে বলেননি। বক্তৃতাতেও একটি শব্দ খরচ করে বিষয়টি সম্পর্কে কোনও অসন্তোষ জানাননি। দুঃখপ্রকাশ তো দূরস্থান!
তবে কি রাম-ধ্বনি শুনে আপ্লুত মোদী ভুলেই গিয়েছিলেন যে, তিনি সেই মঞ্চে শুধু ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা নন, পদাধিকারী হিসেবে দেশেরও শীর্ষনেতা? সরকারি মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর সে দিনের ভূমিকা সাধারণের চোখে এ ভাবেই রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের আপত্তিকর উদাহরণ হয়ে রইল। বস্তুত সম্পূর্ণ নীরব এই মোদী কাদের ‘উৎসাহিত’ করে গেলেন, এবং এতে কোন পালে হাওয়া লাগল, সেটা বুঝতে রকেট বিজ্ঞান লাগে না। আর তাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় ন্যক্কারজনক রাজনীতির একটি ছক।
ঘটনাক্রম এটাও প্রমাণ করে, এর পিছনে কিছু সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল। না হলে, এই কর্ম করে যাঁরা ‘গর্বিত’, বিজেপির সেই যুব নেতারা শুধু মমতাকে ‘রাম’ নাম না-শুনিয়ে মোদীকেও শোনাতে পারতেন! ঘটনার পরে দিলীপ ঘোষেরা দল বেঁধে ‘শ্রীরাম’ বাহিনীর অশালীনতার পক্ষে যে ভাবে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন, সেটাও লক্ষ করার।
অতএব মমতাকে উত্তেজিত করে তাঁর বক্তৃতা ভণ্ডুল করাই এই অপচেষ্টার মূল লক্ষ্য ছিল বললে হয়তো খুব ভুল হবে না। কিন্তু কেন? সস্তার রাজনীতি? না কি, তিনি কী বলতে পারেন, তা নিয়ে প্রতিপক্ষের কোনও আশঙ্কা ছিল? এমন অনেক প্রশ্ন হাওয়ায় ঘুরছে।
বিজেপির বহু নেতা এবং আরও কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, মমতা ‘প্ররোচিত’ না হয়ে বক্তৃতা করে এলেই ভাল করতেন। এঁদের একাংশের ব্যাখ্যা, তা হলে কৌশলকারীরা জব্দ হত। মমতা যে এ সব অসভ্যতা হেলায় তুচ্ছ করেন, সেই বার্তাও পৌঁছত, এবং ভবিষ্যতে এমন করার আগে তারা দু’বার ভাবত।
কিন্তু রাজনীতিতে পোড় খাওয়া মমতা তাৎক্ষণিক বিবেচনায় নিশ্চয় বুঝেছিলেন, তিনি বক্তৃতা না করে শুধু দৃঢ় ভাবে অভব্যতার প্রতিবাদটুকু জানিয়ে সরে এলে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিঘাত বৃহত্তর মাত্রা পেতে পারে। আর সেটা না করে বক্তৃতায় চারটি কড়া কথা শোনালে সেটা অবিলম্বে তৃণমূল-বিজেপি সংঘাতের চেহারা নেবে এবং তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। স্বাভাবিক জনসমর্থন মিলবে না। পরবর্তী প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, মমতার দিক থেকে সিদ্ধান্তটি বোধ হয় ভুল ছিল না।
কারণ, বিষয়টি এখন শুধু মমতার বক্তৃতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি বা প্রধানমন্ত্রীর সামনে মুখ্যমন্ত্রীর অসম্মানের প্রশ্নে থেমে নেই। এইটুকু হলে তার আয়ু হয়তো রাজনৈতিক ভাবে খুব বেশি দিন স্থায়ী হত না। পরিস্থিতি এখন যে দিকে গড়াচ্ছে, তার নানা বাঁক। বৃহত্তর পরিসরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি, আবেগ, জাত্যভিমান। সেই সঙ্গেই সামনে আসছে সুভাষচন্দ্রের আদর্শ, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গ। এটা আরও বড় রাজনীতি।
সোজা কথায়, বাংলায় ভোটের মুখে সহসা নেতাজি-প্রীতির অত্যধিক তাড়নায় বিজেপি একটি কুশলী তাস খেলতে গিয়েছিল। নিজেদের অসংযম ও অবিমৃশ্যকারিতায় চালে ভুল! এ বার পাল্টা চালের সুযোগ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও চাইছেন তাঁর রাজনীতি এগিয়ে নিতে। ফলে খেলা দ্রুত শেষ হবে বলে মনে হয় না। বিজেপির বাঙালিয়ানা এর আগেও আলোচনায় এসেছে। বলতে দ্বিধা নেই, দলটির গায়ে এখনও হিন্দি বলয়ের ছাপ লেপ্টে রয়েছে। তৃণমূল-বিরোধিতার ময়দানে সিপিএম এবং কংগ্রেসের ক্ষয় থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ভোট তারা অনেক বাড়াতে পেরেছে, সন্দেহ নেই। তবে রোমের সিংহাসনে বসতে হলে তো ‘রোমান’ হতে হয়! বিজেপিতে ‘বাঙালি’ হয়ে ওঠার সাধনা তাই এখন তীব্র।
কিন্তু বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান বললে, ‘সহজ পাঠ’-কে বিদ্যাসাগরের লেখা বলে চালালে, কপালে গেরুয়া তিলক কাটা ভৈরবদের লাঠির ঘায়ে বিদ্যাসাগরের মূর্তি চুরমার হলে, অমর্ত্য সেনকে জমি-চোর বানানোর চেষ্টা করলে, পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের বদলে হাঁটু ছুঁলে, বাংলার নেতাদের মুখের কথায় চারটি হিন্দি ছিটিয়ে দিলে বলতেই হবে, ‘বঙ্গালিয়ানা আভি তক্ হজম নেহি হুয়া!’
এই আলোকেই নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মোৎসব পালনকে দেখে নেওয়া যায়। ভেবে অবাক লাগে, ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় প্রধানমন্ত্রীর পূর্বনির্ধারিত সূচিতে নেতাজি ভবনের কোনও স্থানই ছিল না! তা ঠিক হয় তিনি আসার আগের রাতে। আর নেতাজি ভবন সে কথা জানতে পারে তিনি পৌঁছোনোর দু’-চার ঘণ্টা আগে।
যে বাড়ির কোনায় কোনায় সুভাষচন্দ্রের স্মৃতি, যে বাড়ি থেকে শেষ বারের মতো বেরিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন সুভাষ, প্রধানমন্ত্রী যেন হঠাৎ মনে পড়ার মতো সেখানে ঘুরতে গেলেন। এই কি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নমুনা? না কি, নেহাত ভোট-রাজনীতির দায়? বাংলার আবেগ যদি এতে ঘা খায়, সেটা কি খুব দোষের?
ভিক্টোরিয়ায় ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিও তো নিছক মমতার অপমান নয়। অনেক বেশি অবমাননা বাঙালির হৃদয়ে চিরপ্রতিষ্ঠিত দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের। ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক সকল বিভাজনকে যিনি চিরদিন ঘৃণা করেছেন, সংহতির জয়গান গেয়েছেন, তাঁর উদ্দেশে নিবেদিত অনুষ্ঠান এতে অবশ্যই কলুষিত হয়েছে।
হতেই পারে, ‘জয় শ্রীরাম’ অনেকের অন্তরের ডাক! কিন্তু এই নিনাদ যে এখন আধলা ইটের মতো ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দিকে ছুড়ে মারারও অস্ত্র, তাতে তো ভুল নেই। নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সরকারি সমারোহে সেই ইট ধেয়ে এসে প্রশ্রয় পেল। কাল হয়তো অন্যত্র হবে। প্রাক্-নির্বাচনী বাংলায় এই সব প্ররোচনার কৌশল সংঘাতের আবহকে আরও প্রসারিত করবে এবং দায় চাপবে রাজ্যের কাঁধে।
ভোট-রাজনীতি আরও কত নীচে নামবে, জানি না। তবে এটা বাংলাকে বোঝার পথ নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy