রামের নামে যুদ্ধকাণ্ড শুরু হয়েছে, তার নানা নিদর্শন ইতিউতি প্রকাশিত। হয় রাম বলো না-হয় মার খাও। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমাদের মহাকাব্যের নায়ক রাম কি এ রকমই মারমুখী ছিলেন?
রাম কেমন ছিলেন তা এক কথায় বলা অবশ্য খুব মুশকিল। আমাদের দেশে অনেক ভাষা। নানা ভাষায় রামায়ণ অনেক রকম, মহাভারতও বহু প্রকার। এমনকি সংস্কৃতে লেখা বাল্মীকি রামায়ণ বলে যে বইটি চলে, সেই বইটির বাংলা সারানুবাদক রাজশেখর বসু ‘বাল্মীকি গোষ্ঠী’ নামে একটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ, এক বাল্মীকির মধ্যে অনেক বাল্মীকি মিশে আছেন, এক রামের মধ্যে অনেক রাম মিশে আছেন। সুতরাং কেউ যদি ‘এক দেশ এক রাম’-এর কথা ভাবেন ও একমুখী রামমন্ত্রে সবাইকে দীক্ষিত করতে চান, তা হলে রামের নানাত্বকে তিনি বাদ দিচ্ছেন। আমাদের দেশের ভক্তিবাদী ঘরানায় রাম মোটেই মারকুটে নন। তবে যাঁরা রামের নামে মারামারি করছেন, তাঁরা ভক্তির কথা শুনতে চাইবেন না। শক্তিই তাঁদের কাম্য।
সে কথা মাথায় রেখে মারমুখী রামবাদীদের জন্য এমন এক জনের কথা তোলা যাক, যিনি বীরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। বিবেকানন্দ স্বদেশপ্রেমী, বীর সন্ন্যাসী হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখা পড়ে চরমপন্থী বিপ্লবীরা দেশের কাজ করতে উৎসাহিত হতেন। এই মানুষটি হিন্দুধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৮ সালের ২৪ মার্চ অজিতকুমার চক্রবর্তীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেনের কথা। ক্ষিতিমোহন সেনকে কেন তিনি তাঁর আশ্রম বিদ্যালয়ে আনতে চান চিঠিতে তার কারণ স্পষ্ট করে লিখেছিলেন। ‘ক্ষিতিমোহনবাবুর সম্বন্ধে আর একটি কথা শুনে আমি খুব খুশী হয়েছি। তিনি যদিচ প্রাচীন শাস্ত্রজ্ঞ তথাপি আচরণে তিনি অত্যন্ত উদার। তিনি বলেন, এই ঔদার্য তিনি শাস্ত্র হতে লাভ করেচেন। হিন্দুধর্মকে যাঁরা নিতান্ত সঙ্কীর্ণ করে অপমানিত করেন তাঁদের মধ্যে এর দৃষ্টান্ত হয়ত কাজ করবে।’ অর্থাৎ সঙ্কীর্ণ হিন্দুরা নাস্তিক, আধুনিক, অহিন্দু প্রগতিশীলদের ঔদার্যের উদাহরণে ততটা প্রভাবিত হবেন না। যদি উদার হিন্দুকে তাঁদের সামনে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়, তা হলে কাজ হতে পারে। রামনামকে সঙ্কীর্ণ অর্থে মারমুখী বীরত্বের স্লোগান হিসেবে যাঁরা ব্যবহার করতে চান, তাঁদের কাছে রামকথা সম্বন্ধে সেকুলারদের ‘ভাষ্য’ গ্রাহ্য নাও হতে পারে। কিন্তু বিবেকানন্দ? বিবেকানন্দ হিন্দু শাস্ত্র সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল, ‘বীরসন্ন্যাসী’। তাঁর রামভাষ্য কি রকম ছিল?
বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ ভ্রমণ-কাহিনিতে রাম-সীতার প্রসঙ্গ আছে। রামের অংশটি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্যের উপনিবেশবাদী শক্তির প্রতি তিনি খড়্গহস্ত। তাঁর জিজ্ঞাসা ‘তুমি ইউরোপী, কোন্ দেশকে কবে ভালো করেছ?’ ভাল যে করেনি তার প্রমাণ দিচ্ছেন বিবেকানন্দ। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, আফ্রিকা— সব জায়গাতে ইউরোপীয়রা সেখানকার ভূমিপুত্রদের ‘বন্য পশুবৎ’ মেরে ফেলেছে। তাঁর মতে, এই উপনিবেশবাদীরাই নিজেদের ইতিহাসের সূত্রে ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণের ব্যাখ্যা করেন। সাহেবদের মতে, ‘রামায়ণ... আর্য্যদের দক্ষিণি বুনো-বিজয়।’ বিবেকানন্দের জবাব— এ একেবারে ভুল কথা। রামের প্রধান বিরোধী রাবণ সুসভ্য। লিখেছেন, ‘লঙ্কার সভ্যতা অযোধ্যার চেয়ে বেশী ছিল বরং, কম ত নয়ই।’ তার পর বিবেকানন্দ জানান, আধুনিক কালে উপনিবেশবাদী ইউরোপ যে ভাবে নানা দেশকে ছিনিয়ে নেয়, রাম মোটেই সে গোত্রের লোক নন। ‘কোন্ গুহকের, কোন্ বালির রাজ্য, রামচন্দ্র ছিনিয়ে নিলেন – তা বল না?’ এই যে ছিনিয়ে না নেওয়া রামের কথা লেখেন তিনি, তা আমাদের বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ রচনাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। বঙ্কিমের অনুরাগী পাঠক ছিলেন স্বামীজি। বঙ্কিম মহাভারতের নায়ক কৃষ্ণের চরিত্রের ‘প্রকৃত রূপ’ তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্র’ রচনায় তুলে ধরতে আগ্রহী। তাঁরও লড়াই সাহেবদের সঙ্গেই। বঙ্কিম জানেন সাহেবরা ভারতীয় মহাকাব্যের ভুল ব্যাখ্যা করেন। কৃষ্ণকে সাহেবরা রাজ্যলোভী হিসেবে দেখাতে চান। বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ আর ‘ধর্মতত্ত্ব’ পরস্পর পরিপূরক রচনা। তাঁর ‘ধর্মতত্ত্ব’ রচনায় একটা কথা বিশেষ ভাবে খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন। ‘ইউরোপীয় patriotism একটা ঘোরতর পৈশাচিক পাপ!’ কেন তা পাপ? ‘পর-সমাজের কাড়িয়া ঘরের সমাজে আনিব। স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধি করিব কিন্তু অন্য সমস্ত জাতের সর্বনাশ করিয়া তাহা করিতে হইবে।’ তাই উগ্র দেশপ্রেম, বঙ্কিমের মতে পৈশাচিক পাপ। ঠিক কথা। কালিদাসের রঘুবংশ রচনাতেও লেখা হয়েছিল, ‘কেবল শৌর্যের দ্বারা শাসন করা পশুধর্ম’।
কৃষ্ণ তবে কী করেছিলেন? কৃষ্ণজীবনে বল ও ক্ষমার সামঞ্জস্য চোখে পড়ে। যেখানে বিনা যুদ্ধে কাজ মেটে সেখানে কৃষ্ণ কখনও যুদ্ধ করেননি। যেখানে যুদ্ধ করেছেন সেখানে লোকক্ষয় যথাসম্ভব কম করেছেন। জরাসন্ধ অন্য রাজাদের বন্দি করেছিলেন। যুদ্ধ না করে ভীমকে দিয়ে কৃষ্ণ জরাসন্ধকে বধ করালেন। বন্দি রাজাদের মুক্তি দিলেন। বঙ্কিমের ভাষায় কৃষ্ণ ‘Annexationist ছিলেন না।’ কাজেই রাজ্য অপহরণ না করে জরাসন্ধ পুত্র সহদেবকে রাজ্যাভিষিক্ত করে চলে গেলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে কৃষ্ণ সন্ধি স্থাপনের জন্য সচেষ্ট, এমনকি বিরাট নগরে যখন প্রথম যুদ্ধের প্রস্তাব হয়, তখন কৃষ্ণ তার বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন। যে ভাবে বঙ্কিম কৃষ্ণের জীবন ব্যাখ্যা করছেন, পরে সে ভাবেই রামচরিত্র ব্যাখ্যা করেছেন বিবেকানন্দ।
বঙ্কিম ও বিবেকানন্দ কৃষ্ণ আর রামকে এ ভাবে তুলে ধরেন কেন? দুজনেরই দেশের প্রতি টান ছিল গভীর, দেশের জন্য কাজ করতে হবে, বিরোধী শক্তিকে প্রয়োজনে প্রতিরোধ করতে হবে— এই ছিল আদর্শ। উনিশ শতকে ইউরোপে তখন নেশন-বাদের বিস্তার হচ্ছে। বঙ্কিম ও বিবেকানন্দ এই নেশন-বাদের গুরুত্ব যেমন টের পাচ্ছেন, তেমনই তার দুর্বলতাও খেয়াল করছেন। অহেতুক বাহুবল প্রদর্শন এই নেশন-বাদের মুখ্য দোষ। এই দোষ পরিহারের জন্য কৃষ্ণ আর রাম এই ‘ভারতীয়’ চরিত্র দুটিকে আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করছিলেন তাঁরা। এই নায়করা যে মারমুখী নন তা জানাচ্ছিলেন। এঁদের নামে নির্বিচার মারামারি যে চলতে পারে না তাও বোঝাতে চাইছিলেন এক রকম ভাবে।
তাঁরা দুজনেই ভয়ঙ্কর দুই বিশ্বযুদ্ধ দেখেননি। পাশ্চাত্যের নেশনতন্ত্রের কদর্য চেহারা ছিল তাঁদের অভিজ্ঞতার বাইরে। তবে মারমুখী রূপের দুজনেই বিরোধী। একুশ শতকে এখনকার ভারতে সেই নেশন-বাদেরই বিশেষ রূপ গৃহীত। সেই নেশন-বাদেরই প্রকল্প— দেশকে এক রামে এক নামে গড়ে তুলতে হবে। নানাত্বের আদর্শ ভুলে সবাইকে রাম বলাতে তাই রাম-সেবায়েতরা মারমুখী ও বদ্ধপরিকর। দেশের ও স্বজাতের কথা বলতে গিয়ে মারের যে মডেলটি তাঁরা গ্রহণ করছেন তা ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর। এঁদের জন্য বঙ্কিম-বিবেকানন্দের রচনা এক রকম ওষুধ হতে পারে। রামের নামে মারের ধুয়ো নাই বা তুললেন। যাঁরা রাম নাম গ্রহণ করেননি তাঁদেরও এ দেশে বসবাসের সমানাধিকার আছে। শিকাগো বক্তৃতায় বিবেকানন্দ তো একের ধর্ম অন্যে লোপ করবে— এর বিরোধিতাই করেছিলেন। আর বিবেকানন্দের আচার্য রামকৃষ্ণ যিনি ইসলামপন্থায় সাধনা করেছিলেন, তিনি অপরের ধর্মলোপের তীব্র বিরোধী। রামকৃষ্ণদেবও রামপন্থী, তবে মারপন্থী নন। রামলালার মূর্তিটি বড় প্রিয় ছিল তাঁর। রামলালা মানে বালক-রাম— ভক্তি আর বাৎসল্যে তিনি গ্রহণ করেন রামকে। এই সব রামমুখী মানুষের কথা যদি এ কালের মারমুখীরা শুনতেন!
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy