সম্প্রতি সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ আবার দেখলাম। অনেক দিন পরে একটা ছবি দেখলে নানা নতুন কথা মনে আসে। এমনকি খুব চেনা দৃশ্যেও। যেমন, গোড়ার দিকের সেই ইন্টারভিউটি। টেবিলের এক দিকে সিদ্ধার্থ, কলকাতার অগণিত কর্মপ্রার্থী যুবকের এক জন, অন্য দিকে কোম্পানির তিন কর্তাব্যক্তি। ব্যক্তিগত পরিসরে তাঁরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা মানুষ, কিন্তু ওই মঞ্চে সবাই কোম্পানির প্রতিমূর্তি— ক্ষমতার থান কেটে তৈরি করা এক একটি ইউনিফর্ম।
এ-প্রশ্ন সে-প্রশ্নের পরে ওই কর্তাব্যক্তিদের এক জন বলেন, ‘গত দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কোনটি?’ ১৯৭০-এর ছবি। ‘গত দশক’ মানে ষাটের দশক। সিদ্ধার্থ কিছুটা সময় নেয়, বোঝা যায় তার মনের মধ্যে একটা আলোচনা চলছে। ক্ষমতাবানেরা তার দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, ইনকুইজ়িশনের সময় যেমন থাকতেন। তার পর, অভাবী সংসারের বেকার ছেলেটি শান্ত ও স্পষ্ট স্বরে জবাব দেয়: ‘ভিয়েতনামের যুদ্ধ।’ টেবিলের ও-পার থেকে একটি ঠান্ডা গলা জানতে চায়: ‘মানুষের চাঁদে পা-রাখার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা?’
এবং সেই তরুণ এ-বার, এই প্রথম বার, তার মিতবাক নিরাসক্তির খোলস ছেড়ে আন্তরিক আবেগের মুক্তাঙ্গনে এসে দাঁড়ায়, সুগঠিত যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলে, কেন সে মনে করে চন্দ্রাবতরণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রত্যাশিত একটি ঘটনা, আজ না হোক কাল ওটা হতই, কিন্তু ভিয়েতনামের গুরুত্ব অন্য মাত্রার, কারণ সে দেখিয়েছে একটা ছোট্ট এবং গরিব দেশের মানুষ কী ভাবে মহাশক্তির আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারে, কী অসীম সাহস আর প্রত্যয় নিয়ে লড়তে পারে এমন অসম লড়াই... বলতে বলতে সিদ্ধার্থের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, অনায়াসে পড়ে নেওয়া যায় তার দৃপ্ত মনটিকে। এক সময় থেমে যায় সে।
কয়েক সেকেন্ডের তীব্র নীরবতা। তার পর ছুটে আসে ব্রহ্মাস্ত্র: ‘তুমি কি কমিউনিস্ট?’ সিদ্ধার্থ এক পশলা হাসে, তার পরে বলে: ভিয়েতনামের মূল্য বোঝার জন্য কমিউনিস্ট হওয়ার দরকার হয় না। প্রশ্নকর্তা তার দিকে সোজা তাকিয়ে নিরাবেগ দূরত্ব থেকে জানিয়ে দেন: ‘এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। যা-ই হোক, তুমি আসতে পারো।’
কোম্পানির কর্তারা জানেন, শেষ প্রশ্নটা সিদ্ধার্থ কপিবুক স্টাইলে এড়িয়ে গেল। কিন্তু সিদ্ধার্থও জানে, আসলে কোনও উত্তর তাঁরা চাননি, প্রশ্নটাই তাঁদের বিচারসভার রায়। সিদ্ধার্থের দেওয়া জবাবটি একই সঙ্গে নির্ভুল এবং অপ্রয়োজনীয়। ভিয়েতনামের (অ)লৌকিক প্রতিরোধের তাৎপর্য বোঝার জন্যে বাস্তবিকই কমিউনিস্ট হওয়ার কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই প্রতিরোধী সংগ্রামকে ষাটের দশকের সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে বিশ্বাস করা এবং যুক্তিঋদ্ধ আবেগের সঙ্গে সে-বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করা— টেবিলের ও-পারে অধিষ্ঠিত ক্ষমতার চোখে এটাই নিশ্চিত বিদ্রোহ। এবং সেই কারণেই উত্তরটি অপ্রয়োজনীয়। বস্তুত, ক্ষমতাবানদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। কমিউনিস্ট কাকে বলে, কমিউনিজ়মের সংজ্ঞা কী, তা নিয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। ক্ষমতার কাঠামোটিকে যে চ্যালেঞ্জ করে, সেই কাঠামো নিয়ে যে মৌলিক প্রশ্ন তোলে, তাঁদের চোখে সে কমিউনিস্ট। কমিউনিস্ট একটি শব্দ, ক্ষমতার অভিধানে— ক্ষমতাবানের অভিধানে— যার অর্থ: বিদ্রোহী, প্রতিস্পর্ধী, শত্রুপক্ষ। আরও ছোট করে বললে, জুজু।
প্রসঙ্গত, ছবির অন্তিম পর্বে আর একটি ইন্টারভিউয়ের পালা আসে, যেখানে কর্তৃপক্ষের নির্মম অমানবিকতার প্রতিবাদে সিদ্ধার্থ শেষ অবধি ‘আপনারা কী... ভেবেছেন কি’ বলে ফেটে পড়ে, সরাসরি— প্রচলিত অর্থেই— বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তখন খেয়াল করতে পারি, বিস্ফোরণের বীজ নিহিত ছিল ওই প্রথম ইন্টারভিউয়ের দৃশ্যেই। বিদ্রোহের মাত্রাটি সেখানে অনেক বেশি সূক্ষ্ম, তাই আমরা হয়তো তখন তাকে ঠিক চিনতে পারিনি। কিন্তু আগ্নেয়গিরির ভিতরে কী হচ্ছে, কোম্পানির ক্ষমতাবানেরা সেটা তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলেছিলেন। না বুঝে তাঁদের উপায় নেই— ক্ষমতা ধরে রাখার দায় প্রাণের দায়ের অধিক। তাঁদের জান্তব বোধই ক্ষমতার প্রহরীদের সতর্ক করে দেয়: ভিয়েতনাম, বাপ রে! অ্যানিমাল ইনস্টিংট কথাটা জন মেনার্ড কেনস বিনিয়োগকারীদের একটি বিশেষ প্রবৃত্তি বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তার বৃহত্তর অর্থটি অনায়াসে পাভলভের কুকুর অবধি পৌঁছে যায়। ষাটের দশকের শেষে, স্থিতাবস্থার অচলায়তন জুড়ে যখন ‘গেল গেল’ রব উঠেছে, সেই সময় চাকরির ইন্টারভিউয়ে সাগর-পেরিয়ে-বোমা-ফেলে-আসা মহাশক্তির বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের বন্দনা শুনে কর্তৃপক্ষের মন তো প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠবেই।
অর্ধ শতাব্দীতে অনেক কিছু পাল্টেছে, ক্ষমতাবানদের জুজুর ভয় যায়নি। এমনকি যাদের কমিউনিস্ট বলা হত, সেই সব দেশে পালাবদলের পরেও যায়নি। মার্কিন দুনিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোডি ডিন ২০১২ সালে প্রকাশিত কমিউনিস্ট হরাইজ়ন গ্রন্থে লিখেছিলেন: ‘‘পুঁজিবাদী, কনজ়ার্ভেটিভ এবং লিবারাল-গণতন্ত্রীরা অনেক সময় প্রচার করে যে, কমিউনিজ়ম হল একটি বিলুপ্ত দিগন্তরেখা। কিন্তু সচরাচর তারা নিজেরা কমিউনিজ়ম-এর থেকে কিছুতেই নজর সরায় না। তারা কমিউনিজ়মের তথাকথিত মৃত্যুর কুড়ি বছর পরেও তাকে ভয় পায়।’’ সে-ভয় এতই প্রবল যে স্থিতাবস্থার রক্ষীরা রাজনৈতিক আলোচনা করতে গিয়ে কেবলই প্রমাণ করতে চায়— কমিউনিজ়ম ব্যর্থ হয়েছে, তা কোনও বিকল্প হতেই পারে না। অর্থাৎ, যে আর্থিক ব্যবস্থাটি বিশ্ব জুড়ে উত্তরোত্তর আধিপত্য বিস্তার করেছে (এবং পৃথিবীটাকে এই ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে দিয়েও যার ক্ষান্তি নেই), সেই নিয়োলিবারাল ধনতন্ত্রই একমাত্র গতি। মার্গারেট থ্যাচারের ভাষায়, দেয়ার ইজ় নো অল্টারনেটিভ— টিনা।
কথাটা বেবাক মিথ্যে। বিকল্প আছে। নিয়োলিবারাল মতাদর্শের ধারক এবং বাহকরা সেটা বিলক্ষণ জানেন। জানেন বলেই এমন একমনে ‘টিনা’র একতারাটি বাজিয়ে চলেন। জানেন বলেই কমিউনিস্ট শব্দটিকে তাঁরা পরম নিষ্ঠার সঙ্গে অচ্ছুৎ করে রেখেছেন, সমাজতন্ত্র বললেই স্তালিন আর উত্তর কোরিয়ার ভয় দেখিয়ে এসেছেন। আজও সেই ট্র্যাডিশন চলছে। অথচ, ঘটনা হল, সোভিয়েট মডেল এবং তার রকমারি শাখাপ্রশাখা ও বিকৃতির বাইরে বিকল্প সন্ধানের বহু পথ আছে। দুনিয়া জুড়ে নানা দেশেই, এমনকি ট্রাম্পের আমেরিকায় বা মোদীর ভারতেও, কৃষি সমবায় থেকে শ্রমিকদের পরিচালিত সংস্থা, পারস্পরিক সহযোগিতায় গড়ে তোলা স্থানীয় অর্থনীতি থেকে পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনের যৌথ উদ্যোগ— নানা ভাবে নিয়োলিবারাল মতাদর্শকে প্রত্যাখ্যান করে বিকল্পের অনুশীলন চলছে। সেই সব বিকল্পকে সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজ়ম বললে ভুল হবে, কিন্তু তারা প্রতি মুহূর্তে ‘কমিউনিস্ট হরাইজ়ন’টির কথা মনে করিয়ে দেয়, বিকল্পের অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে নানা দিক থেকে সমাজের ওপর সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট আদর্শের ছায়া এসে পড়ে। সে-আদর্শ অগণন মানুষকে মুনাফাসন্ধানী পুঁজির শাসনে চালিত বাজারের নির্মম ও অনিশ্চিত দরিয়ায় ছেড়ে না দিয়ে তাঁদের জীবিকা ও জীবনকে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলে। এমন ছায়া যে স্বাস্থ্যকর, তা বোঝার জন্য কমিউনিস্ট হওয়ার দরকার হয় না। মানুষের স্বাভাবিক বোধই তাকে সে-কথা জানিয়ে দিতে পারে।
এবং সেই কারণেই ক্ষমতার অধিপতি বা সেপাই-সান্ত্রিদের ভয় পাওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। বিকল্প যে আছে, এই বোধ যদি সমাজের চেতনায় সঞ্চারিত হয়, তা হলে স্থিতাবস্থার সমূহ বিপদ, কারণ ‘বিকল্প নেই’ মন্ত্রের আফিম দিয়েই না এত দিন মানুষকে স্থিতাবস্থার ঘেরাটোপে বশ করে রাখা! অতিমারির পৃথিবীতে এক দিকে প্রচলিত ব্যবস্থাটির বীভৎস অ-ন্যায়ের হাঁড়িগুলো হাটের মাঝে ভেঙে যাচ্ছে, অন্য দিকে ছোট, মাঝারি ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় আকারে নানা বিকল্প চোখের সামনে গড়ে উঠছে এবং সফল হচ্ছে। সিদ্ধার্থরা, আজ না হোক কাল, হঠাৎ আস্তিন গুটিয়ে ‘আপনারা কী ভেবেছেন কি’ বলে ফেটে পড়বে না— অচলায়তনের মালিকদের কে তার গ্যারান্টি দেবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy