সুকুমার সেন। ফাইল ছবি
আজ আর একটু পরেই মাসখানেকের ওপর চলতে থাকা গণতন্ত্রের যজ্ঞের ফলাফল। উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনছেন অনেকে। এর পরে কী হবে? আশা, আশঙ্কায় আক্রান্ত অনেকে। কিন্তু এর মধ্যে বিস্মৃত হয়েই থাকবেন এক বাঙালি, প্রায় সত্তর বছর আগে ভারতের প্রথম গণতন্ত্রের উৎসব পরিচালনার দায়িত্ব ছিল যাঁর ওপরে। তিনি সুকুমার সেন, ভারতের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। আর এই বাঙালির শিকড় আছে বর্ধমানে। অবিভক্ত বাংলার বর্ধমানে শৈশব, কৈশোর কেটেছে এই বিস্মৃত বাঙালির। স্কুলের পড়াশোনা করেছেন বর্ধমানের মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুলে। পরে ফিরেছিলেন এই বর্ধমানেই, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হয়ে। সুকুমার সেনের জন্ম ১৮৯৯-এ। বাবা অক্ষয়চন্দ্র সেন ছিলেন আইসিএস। সুকুমার সেনের অন্য দুই ভাইও নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিখ্যাত। এক জন, অশোককুমার সেন ছিলেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী। আর এক জন, অমিয়কুমার সেন ছিলেন চিকিৎসক, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিনে ছিলেন তাঁর সঙ্গে।
জীবনের অনেকটা সময় বর্ধমানে কাটানো বিস্মৃত বাঙালি সুকুমার সেন এ দেশে নির্বাচন পরিচালনায় পথিকৃৎ। পথিকৃতের কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না মোটেই। ৪৫০০ আসনে ভোট। ৫০০টি সংসদের, বাকি বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভার। ২,২৪,০০০ ভোটদান কেন্দ্র। কুড়ি লক্ষ ইস্পাতের ব্যালট বাক্স, বানাতে লেগেছে ৮২০০ টন ইস্পাত। ৫৬০০০ প্রিসাইডিং অফিসার, সহায়ক আরও ২৮০০০০ কর্মী। নির্বাচকদের নাম টাইপ করে নির্বাচনকেন্দ্র অনুযায়ী সাজিয়ে ভোটার লিস্ট তৈরি করার জন্য ছ’মাসের চুক্তিতে নিয়োগ করা হয়েছিল ১৬৫০০ কর্মীকে। ভোটার লিস্ট ছাপতে লেগেছিল ৩,৮০,০০০ রিম কাগজ। কেন্দ্রীয় বাহিনী তখন তৈরিই হয়নি, অতএব শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভরসা ছিলেন প্রায় সওয়া দু’লাখ পুলিশকর্মী। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচন কী সে বিষয়ে কোনও ধারণাই তখনও পর্যন্ত ছিল না নির্বাচকদের।
বিষয়টা যে কত কঠিন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন সুকুমার সেন। প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে তিনি আর একটু অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। এই বিস্মৃত বাঙালি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় খুব কমই। কোনও স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী তিনি লেখেননি। তাঁর সম্পর্কেও লেখা পাওয়া যায় খুব কম। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘ইন্ডিয়া আফটার গাঁধী’-তে লিখেছেন, ‘গণিতজ্ঞ বলেই বোধহয় সেন প্রধানমন্ত্রীকে ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন। কেন না এর আগে কোনও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাকে এমন প্রকাণ্ড কাজ সমাধা করবার ভার দেওয়া হয়নি, কোনও ভারতীয় কর্মকর্তাকে তো নয়ই। সবার আগে নির্বাচক মণ্ডলীর বিশাল আকারের কথাটা ভাবুন---একুশ বছর বা তার বেশি বয়সের ১৭ কোটি ৬০ লক্ষ ভারতীয় ভোট দেবে, তার মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ পড়তে বা লিখতে জানে না। প্রত্যেকটি ভোটারকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে হবে, নাম লিখে নথিভুক্ত করতে হবে। নথিভুক্ত করাটা কেবল প্রথম ধাপ মাত্র। কেন না প্রধানত নিরক্ষর এক নির্বাচকমণ্ডলীর জন্য কী ভাবে পার্টি প্রতীক, ভোটপত্র আর ব্যালট বাক্স তৈরি করতে হবে, সে এক বিরাট প্রশ্ন।’
এই বিপুল কর্মযজ্ঞের জন্য নেহরু, সুকুমার সেনকেই বেছে নিয়েছিলেন। তার একটা কারণ নিশ্চয় সুকুমার সেনের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা। বাইশ বছর বয়সে, ১৯২১ সালে সুকুমার সেন যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে। প্রথমে কাজ করেছিলেন নানা জেলায়। তার পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব পদে যোগ দেন। সেখানে তাঁর কর্মদক্ষতার কথা পৌঁছেছিল প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কানেও। স্বাধীনতার দু’বছর পরেই গঠিত হল নির্বাচন কমিশন। নেহরুর আশা ছিল ১৯৫১-র প্রথম দিকেই স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচন করানো যাবে। আর এ কাজে সুকুমার সেনকে বেছে নেওয়ার আর একটা কারণ হতে পারে গণিতে সুকুমার সেনের বিশেষ জ্ঞান। সে সময়ের ভারতে সুকুমার সেন বিশিষ্ট গণিতবিদ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ করে সুকুমার সেন পড়তে যান লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে গণিতে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন।
তাঁর প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো সুকুমার সেন বুঝতে পেরেছিলেন নির্বাচন বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করাই ভাল। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি একটু ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন। কারণ ভোটপত্র আর ব্যালট বাক্স যদিও বা তৈরি করা গেল, ভোটকেন্দ্র কোথায় কোথায় হবে সেটা নির্দিষ্ট করার কাজটা সময়সাপেক্ষ। এলাকার ভূগোল, পরিবহণের ব্যবস্থা সব দিক মাথায় রেখে ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করাটা এক বিপুল কাজ। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল ১৯৫২-র প্রথম দিকে ভোট হবে। হলও তাই। আর সেটা সামগ্রিক ভাবে ছিল সফল। তুরস্ক থেকে আসা এক সাংবাদিক ভোট শেষ হলে তাঁর দেশের এক প্রতিনিধি দলকে নিয়ে সুকুমার সেনের সঙ্গে দেখা করেন। রামচন্দ্র গুহ লিখছেন, ‘মুখ্য নির্বাচন কমিশনার তাঁদের ভোট বাক্স, ভোটপত্র আর প্রতীকের কিছু নমুনা দেখান, সেই সঙ্গে দেখান ভোটকেন্দ্রের ছক, যাতে তাঁরা তাঁদের নিজেদের দেশে গণতন্ত্রের ব্যাহত প্রক্রিয়াকে নতুন করে চালু করতে পারেন।’ দেশের এই প্রথম নির্বাচন পরিচালনা করতে গিয়ে আর একটি সমস্যার মুখে পড়েছিলেন সুকুমার সেন। দেশের বহু মহিলা ভোটার নির্বাচক তালিকা তৈরির সময় নিজের নাম বলেননি, পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁদের বাবা স্বামী বা ছেলের নামে। বিষয়টাকে অন্য একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন ভারতের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। অমুকের মা বা স্ত্রীর পরিচয়-লেখা ভোটারদের তিনি তালিকা থেকেই বাদ দিয়েছিলেন। যুক্তি ছিল, পরবর্তী নির্বাচনে অন্তত ভোট দেওয়ার জন্য এই কুসংস্কার কিছুটা কাটবে।
১৯৫৭-র দ্বিতীয় নির্বাচনও পরিচালনা করেন সুকুমার সেন। পরে সুদানে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এমন বাঙালিকে মনে রাখিনি আমরা। বিস্মৃতি এতটাই যে কখনও কখনও ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেনের সঙ্গে তাঁকে গুলিয়ে ফেলা হয়। তবু বর্ধমানে একটি রাস্তার নাম তাঁর নামে হয়েছে। আর সম্প্রতি সাত দশকের ভারতের নির্বাচন নিয়ে বিবিধ ইংরেজি প্রবন্ধের একটি সংকলন (দ্য গ্রেট মার্চ অব ডেমোক্রেসি: সেভেন ডিকেডস অব ইন্ডিয়াজ ইলেকশন) উৎসর্গ করা হয়েছে সুকুমার সেন আর টিএন শেষনের নামে। প্রথম জন নির্বাচন কমিশনের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন, আর দ্বিতীয় জন তার মেরুদণ্ড শক্ত করেছিলেন।
উপ-পরিচালক গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy