অনারব্ধ: বিরোধী নেতাদের সভায় কপিল সিব্বল, চন্দ্রবাবু নায়ডু, অভিষেক মনু সিংভি, অরবিন্দ কেজরীবাল ও অন্যরা, দিল্লি, ১৪ এপ্রিল। পিটিআই
সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনপর্ব চলছে। রাজনীতির কুনাট্যরঙ্গ যথারীতি নির্বাচনকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। অনিবার্য ভাবেই এসেছে এক দিকে সম্ভব-অসম্ভব নানা রকম রঙিন প্রতিশ্রুতি এবং অন্য দিকে রাজনৈতিক নেতাদের মুখে কুকথার অবিরাম স্রোত। কিন্তু এ সব ছাড়িয়েও যে ঘটনা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তা হল কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসাবে পরিচয়কে ছাপিয়ে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ। ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গঠনের আওয়াজ দিয়ে আদতে ‘গণতন্ত্রমুক্ত ভারত’ গঠন অনিবার্য করে তোলা হচ্ছে। এর ফলে এখন প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত, ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপটে শুধু সংখ্যালঘু মুসলিমরাই নয়, দলিত ও আদিবাসীরাও আক্রান্ত, গোরক্ষার নামে তাণ্ডবের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নিরীহ সাধারণ মানুষ। মানুষের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে রহন-সহন, আচারবিচার ও সংস্কৃতির ভিন্নতাকে আক্রমণ করে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’ নীতিতে ধ্বংস করতে চাওয়া হচ্ছে এ-তাবৎ ভারতীয় সংস্কৃতির মূল সুর ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। এক একমাত্রিক বুলডোজ়ার চালিয়ে সমস্ত ভিন্নতাকে মুছে দিতে চাইছে বিজেপির সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী নীতি। চরম দারিদ্র ও তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত মানুষজন এই নাগপাশ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে।
এই অবস্থায় প্রত্যাশিত ছিল যে, দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-বামপন্থী শক্তির মহাজোট গড়ে এই কালাপাহাড়ি তাণ্ডবকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে। প্রত্যাশিত ছিল যে, এই আক্রমণের বর্শাফলক যে রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নিবদ্ধ, সেই কংগ্রেস দলকে ঘিরেই সর্বভারতীয় এই মহাজোট বাস্তবক্ষম হবে। আসলে দেশের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন ছিল সেই অগ্নিপরীক্ষার কাল। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হল, সেই মহাজোট গঠনের কোনও লক্ষণ এখনও দেখা যায়নি।
এই মহাজোট গঠনের সূচনাপর্বেই আওয়াজ উঠেছিল বিকল্প ফেডারাল ফ্রন্ট গঠনের। এবং পরবর্তী কালে এই ফ্রন্টের কথা আর তেমন শোনা না গেলেও দেশে বিভিন্ন রাজ্যভিত্তিক আঞ্চলিক দলের সম্ভাব্য মহামিলনকেই বিকল্প হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা শুরু হয়েছে। ঘটনা হল, যে কংগ্রেস দলকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে মহাজোট গঠনের সম্ভাবনা ছিল, আঞ্চলিক দলগুলি নিজ নিজ রাজ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার তাগিদে সেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই আক্রমণের বর্শাফলক তুলে ধরতে বাধ্য হচ্ছে এবং এর ফলে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লড়াই ক্রমেই দিশাহীন ও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অভিযোগ, বিশেষ করে ‘জরুরি অবস্থা’র সময়ে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ঘটনা অবশ্যই অস্বীকার করা যায় না। আমি নিজেই সত্তরের দশকে সাত বছর কংগ্রেসের জেলে কাটিয়েছি। কিন্তু দেশ ও জাতির ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ বিরোধিতাই এখন মুখ্য বিষয়।
এমতাবস্থায় কেউ কেউ মমতাদেবীর এখনকার কট্টর বিজেপি-বিরোধিতায় বিভ্রান্ত হয়ে তৃণমূলের সহায়তায় ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে প্রতিহত করার খোয়াব দেখছেন। কিন্তু মুখে যতই কট্টর বিরোধিতা করুন না কেন, মমতাদেবী ১৯৯৯ থেকে একাধিক বার বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছেন এবং বিজেপির নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য থেকেছেন। এখনও তাঁর ফেডারাল ফ্রন্টের আওয়াজ বা আঞ্চলিক দলগুলির জোট গঠনের পরিকল্পনা কার্যক্ষেত্রে বিজেপি-বিরোধী মহাজোট গঠনের পথে বড় বাধা হয়ে উঠেছে। বস্তুত, তিনি যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গে বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ আসন জয় করার কথা বলে চলেছেন, তা কার্যক্ষেত্রে সিপিআইএম এবং কংগ্রেসকে সরিয়ে রাজ্যের বিরোধী পরিসরটি বিজেপির কব্জায় চলে যাওয়ার পথই প্রশস্ত করছে। এই অবস্থায় তাঁর উপর নির্ভর করে বিজেপিকে প্রতিহত করার কর্মসূচির কোনও যৌক্তিকতা নেই।
অন্য দিকে আবার কেউ কেউ পশ্চিমবঙ্গে আইনি শাসনের বদলে মর্জির শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে বিজেপির সহায়তায় মমতাদেবীকে পর্যুদস্ত করার কথা ভাবছেন। এ কথা ঠিক যে মমতাদেবীর ‘বিরোধীশূন্য’ পশ্চিমবঙ্গের আওয়াজ, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের সক্রিয়তা এবং তৃণমূল কংগ্রেস দলের তোলাবাজি ও গুন্ডারাজের ফলে মানুষজনের অতিষ্ঠ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, কিন্তু টিএমসির জায়গায় বিজেপিকে ডেকে আনার অর্থ হবে তপ্ত কড়াই ছেড়ে জ্বলন্ত উনুনে পড়া।
এই সন্ধিক্ষণে এই দিশাহীনতার মুখে একমাত্র বামপন্থীরাই উপযুক্ত ভূমিকা নিয়ে পথপ্রদর্শক হতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে হীনবল, ক্ষীণকায় বামপন্থীদের সেই সক্ষমতা আর নেই। এ কথা ঠিক যে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে বামপন্থীরা বরাবরই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন এবং সেই সংগ্রামে তাঁদের গৌরবময় ঐতিহ্য দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। সারা শরীরের তুলনায় মেরুদণ্ড আকারে ছোট হলেও যেমন সারা অবয়বকে ধরে রাখে, তেমনই ক্ষুদ্র হলেও বামপন্থীরা দীর্ঘ দিন ধরেই সর্বভারতীয় রাজনীতির অবয়বটিকে ধরে রেখেছেন। তাই অস্বীকার করা যায় না যে, বামপন্থী শক্তির উপরেই সর্বভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভরশীল। মনে করা যেতে পারে, এ কারণেই ইউপিএ-১ সরকারের মন্ত্রিসভায় শামিল না হলেও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বামপন্থীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে বামপন্থীরা এখন অপ্রাসঙ্গিকপ্রায়, তাই দিশারি হিসাবে এখন তাঁদের কাছে প্রত্যাশা রেখে লাভ নেই।
কিন্তু এটা শুধু শক্তিহীনতার প্রশ্ন নয়। সমান ভাবে এটা দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রশ্ন। আসলে সংসদকে কী ভাবে ব্যবহার করা হবে, সেই প্রশ্নে বামপন্থীরা নিজেরাই দিশাহীনতায় ভুগছেন। লক্ষ করার বিষয় হল, একদা বামপন্থীরা সরকারের নীতিহীনতা ও অপদার্থতা উন্মোচনের জন্য সংসদীয় সংগ্রামকে ব্যবহার করতেন। স্মরণ করা যেতে পারে, ষাটের বা সত্তরের দশকে, এমনকি আশির দশকের শুরুর দিকেও ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব জিন্দাবাদ’, ‘শ্রমিক-কৃষক ঐক্য জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি প্রকার স্লোগান দেওয়াল লিখনে দেখা যেত। এ সব স্লোগান এখন আর চোখে পড়ে না। এখন আর দশটা নির্বাচনসর্বস্ব পার্টির মতোই বামপন্থীরাও স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। কথা উঠতে পারে যে, নির্বাচনে এই সব স্লোগানের কোনও কার্যকারিতা নেই। কথাটা ঠিকই। কিন্তু নির্বাচনই যে শেষ কথা নয়, বা নির্বাচন যে কোনও মৌলিক সমস্যার সমাধান করে না, এই সত্য তুলে ধরে বামপন্থীদের নিজেদের দিশা ঠিক রাখার জন্য এই স্লোগানগুলি প্রাসঙ্গিক ও জরুরি।
আসলে এই ঝোঁক প্রবল হয়েছে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনের পর। ষাটের দশক বা সত্তরের দশকের গোড়াতে বামপন্থীরা সংসদীয় ব্যবস্থার স্বরূপ উন্মোচনের জন্য সংসদে যেতেন। সংসদীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার গঠন করে বা বন্ধু সরকারের সহায়তায় জনগণকে রিলিফ দেওয়ার চিন্তা থাকলেও তা কখনও একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গাঁধীর স্বৈরাচারী সরকারকে হটাবার জন্য আন্দোলনের পথ বা সশস্ত্র পথের বদলে বরং সংসদীয় বিকল্প সরকার গঠনই মানুষজনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ এই ঐতিহাসিক শিক্ষা নেন যে, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদল সম্ভবপর, এবং যে হেতু সংসদই ক্ষমতা অনুশীলনের কেন্দ্র, তাই সংসদ দিয়ে, মানুষের মৌলিক সমস্যা না হোক, আশু সমস্যার সমাধান হতে পারে।
এর পর থেকেই ভারতীয় জনগণের সংসদ-নির্ভরতা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। অবস্থা এমনই হয় যে, পিছিয়ে-থাকা জাতির বা এলাকার মানুষজন ভাবতে শুরু করেন, তাঁদের জাতির বা এলাকার মধ্যে থেকে তাঁদের প্রতিনিধি করে সংসদে পাঠালে জাতির বিকাশ বা এলাকার উন্নতি ঘটতে পারে। পরিতাপের বিষয় হল, বামপন্থীরাও এই স্রোতে ভেসে গিয়েছেন এবং এই ভাবে কার্যত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার ধ্বজাধারী হয়ে উঠেছেন।
টিভির আলোচনায় প্রায়শই শুনি, রাজনীতি হল ‘সম্ভাবনার শিল্প’, অর্থাৎ সম্ভবপর বিকল্পগুলির মধ্যে গ্রহণযোগ্যতমটির নির্বাচন। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এ দেশের বামপন্থীরা মূলত এই কথাটাই মেনে চলছেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে কিউবা এবং বলিভিয়ার বিপ্লবী নেত্রী মার্তা হার্নেকারের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর ‘বামপন্থার পুনর্নির্মাণ’ গ্রন্থে মার্তা বলেছেন, রাজনীতিকে সাধারণত ‘সম্ভাবনার শিল্প’ বলা হয়ে থাকে, কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতি হল ‘অসম্ভবকে সম্ভব করার শিল্প’। অতীতে এ দেশে বামপন্থীরা অসম্ভবকে সম্ভব করার এই শিল্পই অনুশীলন করে এসেছেন। এ দেশে তাঁদের যেটুকু শক্তিসঞ্চয়, তা এই অনুশীলনেরই ফল। অথচ, দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সংসদীয় ভুলভুলাইয়ায় বিচরণ করতে করতে বামপন্থীরা এখন এই সত্য ভুলতে বসেছেন।
এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের কোনও গুরুত্ব নেই। বস্তুত, এই সংগ্রাম ছাড়া দেশে গণতন্ত্র রক্ষা করা যাবে না। আর, গণতন্ত্র ছাড়া বিপ্লবী সম্ভাবনার বিকাশও অসম্ভব। এই চক্রব্যূহের মধ্যেই দেশের রাজনীতি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy