পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রে দেবী সরস্বতী বীণা-পুস্তকধারিণী। যদিও ঋগ্বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীস্বরূপা। বিদ্যাদাত্রী-বীণাবাদিনী নন। মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমীতে যে হংসবাহনা সরস্বতীর আমরা পুজো করি, তিনি সেই নদীরূপা সরস্বতীর প্রবাহিত রূপ। বলা যায়, হিন্দুধর্মে বিবর্তনের প্রমাণ। এই সরস্বতী নদীতীরে গড়ে উঠেছিল বৈদিক সভ্যতা। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদেরা প্রথমে ঋগ্বেদে উল্লিখিত সপ্তসিন্ধুর মধ্যে সরস্বতীর অস্তিত্বকে কাল্পনিক ধরে নিয়েছিলেন। পরে আবিষ্কৃত হয়, থর মরুভূমি লুপ্ত সরস্বতীর প্রবাহখাত। সরস্বতী বর্তমানে মরুময় হলেও বৈদিক সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে ছিলেন রসময়ী। তাই, ‘সরসবতী’ থেকে সরস্বতী।
বৈদিক ঋষিরা নদী সরস্বতীকে প্রাণহীন জলপ্রবাহ হিসেবে দেখেননি। সরস্বতীর প্রবাহে প্রাণ অনুভব করেছিলেন। আজ পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ সচেতনতার স্লোগান উঠেছে। অথচ ভেবে অবাক লাগে, খ্রিস্টের জন্মের বহু যুগ আগে থেকেই বৈদিক ঋষি-কবিরা পরিবেশ সচেতন ছিলেন। নদীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের প্রথম প্রমাণ ধরা রয়েছে ঋগ্বেদেই। এই বেদ ধ্বনিত হওয়ার প্রথম যুগে অর্থাৎ প্রথম মণ্ডলের ৩৪তম সূক্তে বেদের সাতটি নদীকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে, অশ্বিদ্বয় দেবতার জন্য সপ্তমাতৃ জল দিয়ে—‘সিন্ধুভিঃ সপ্তমাতৃভিঃ’—হব্য তৈরি হয়েছে। সূক্তটির মন্ত্রদ্রষ্টা বা রচনাকার হলেন ঋষি অঙ্গিরার ছেলে হিরণ্যস্তুপ। দ্বিতীয় মণ্ডলের ৪১ সংখ্যক সূক্তের রচনাকার গ্রিৎসমদ ঋষি। ইনি তাঁর যজ্ঞে নদী সরস্বতীকে প্রথমে ‘অম্বিতমে’ অর্থাৎ মায়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলেছেন। পরে বলেছেন, ‘নদীতমে দেবিতমে সরস্বতী’ (নদী ও দেবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ)। ঋষি গ্রিৎসমদ সরস্বতী নদীমায়ের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন, আমরা সমৃদ্ধহীন রয়েছি, আমাদের সমৃদ্ধিশালী করুন। সরস্বতীর উদ্দেশে সোমরস নিবেদন করে তিনি সন্তান চেয়েছেন। নদীরূপা মা সরস্বতীর কাছে চেয়েছেন অন্ন-জলও।
বৈদিক যুগে ভরত নামে গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল। তৃতীয় মণ্ডলের ২৩ সংখ্যক সূক্তের দ্রষ্টা ঋষিরা হলেন ভরতের দুই ছেলে দেবশ্রবা ও দেবরাত। এঁরা অগ্নিদেবের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন, অগ্নি যেন দৃষ্যদ্বতী, আপযা ও সরস্বতী নদীতীরের মানুষের ঘরে ধনরূপে দীপ্ত হন। ঋগ্বেদের পুরো ষষ্ঠ মণ্ডলের দ্রষ্টা ঋষি ভরদ্বাজ। এই মণ্ডলের চোদ্দটি মন্ত্রে গাঁথা ৬১ সংখ্যক সূক্তের দেবতা স্বয়ং নদী সরস্বতী। যে সরস্বতী কালের প্রবাহে ভারতের ভূগোল থেকে মুছে গেল, সেই নদী বৈদিক যুগে কী বিপুল পরিমাণ জল নিয়ে সবেগে প্রবাহিত হত, তার প্রমাণ মেলে উক্ত সূক্তের দ্বিতীয় ঋকে। ভরদ্বাজ জানাচ্ছেন, সরস্বতী প্রবল ও বেগবতী হয়ে পর্বতের সানুদেশ ভাঙছেন। নদীদেবী সরস্বতীর ভয়ঙ্করী রূপ দেখে ঋষি বলেছেন, আমরা নিজেদের রক্ষার জন্য স্তুতি ও যজ্ঞে দু’কুলনাশিনী সরস্বতীর পরিচর্যা করছি।
এখানেই শেষ নয়। যে ‘কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে’ শান্ত সরস্বতীকে আমরা দেখি, ঋষি ভরদ্বাজের বয়ানে তিনি সম্পূর্ণ উল্টো। মায়াবী বৃসয়ের ছেলে তথা দেববিরোধীদের দেবী বধ করেছিলেন। সরস্বতী এখানে ‘ঘোরা হিরণ্যবর্তনিঃ’ (সোনার রথে চড়ে ভীষণারূপে শত্রু নিধন করেন)। তাই ঋষি ভরদ্বাজ নদী সরস্বতীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী, সরস্বতীর কাছে সংগ্রামে রক্ষা করার প্রার্থনা জানিয়েছেন। এমনকি, নিন্দুকদের হাত থেকে বাঁচার জন্যও সরস্বতীর শরণ নিয়েছেন। নদী সরস্বতীর বন্যায় যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হতে হয় সে জন্য প্রার্থনা জানিয়েছেন, ‘স্ফরীঃ পয়সা মা ন আ ধক’ (বেশি জলে স্ফীত যেন না হন)। রোজকার জীবনে চাওয়া-পাওয়ার সব কথাই নদী সরস্বতীকে বলেছেন ঋষিকবিরা। কারণ, নিছক নদী তো নন, তিনি যে মা। এই সূক্তে দেবী সরস্বতীকে অন্নদাত্রী, ভূমিদাত্রী, সমৃদ্ধদায়িনী, বারিদাত্রী রূপেও পাওয়া যায়।
উক্ত সূক্তের পঞ্চম সংখ্যক ঋকে বলা হচ্ছে, যে ব্যক্তি দেবী সরস্বতীকে ইন্দ্রের মত স্তব করে ধনের জন্য যুদ্ধে যায়, দেবী তাঁকে রক্ষা করেন। আমরা জানি, বেদের প্রধান দেবতা ইন্দ্র। কিন্তু উক্ত ঋক প্রমাণ করে, বৈদিক ঋষিদের কাছে নদীরূপী সরস্বতীর গুরুত্ব ছিল ইন্দ্রের সমান। ঋষি ভরদ্বাজের সরস্বতী কীর্তনে পাই— ইনি ত্রিলোকবাসিনী, সপ্ত অবয়বা, দেবী নিজের দীপ্তি দিয়ে পৃথিবী ও স্বর্গকে আলোকিত করে রেখেছেন। সরস্বতী তীরের গার্হস্থ্য জীবনে ঋষিরা যেমন সুখ-শান্তি পেয়েছিলেন, তেমনই মনন-চিন্তায় পরম জ্ঞান বা পরাবিদ্যার অধিকারী হয়েছিলেন। আলোচ্য সূক্তের শেষ ঋক থেকে বোঝা যায়, সে ছিল বড় সুখের দিন। তাই নদীদেবী সরস্বতীকে ঋষি ভরদ্বাজ আহ্বান জানাচ্ছেন—দেবি, আমাদের বন্ধুতা ও আবাস স্বীকার করো। তাঁর ইচ্ছে, চিরকাল যেন তাঁরা সরস্বতী-তীরে বাস করতে পারেন। সেই বাসনা থেকে উচ্চারিত হয়েছে, ‘মা ত্বৎ ক্ষেত্রাণ্যরণানি গম্ম’ (তোমার এই ক্ষেত্র থেকে অন্যত্র যেন যেতে না হয়)। সপ্তম মণ্ডলের ৯৫ ও ৯৬ সংখ্যক সূক্তের প্রথম তিনটি ঋকের দেবতাও সরস্বতী। সূক্ত দু’টির রচনাকার বা দ্রষ্টা ঋষি বশিষ্ঠ। তিনিই প্রথম বলেছেন সরস্বতীর গাত্রবর্ণ সাদা। প্রার্থনা জানাচ্ছেন, ‘বর্ধ শুভ্রে’ (হে শুভ্রবর্ণা, বর্ধিত হও)। সেই সূত্রেই দেবী শ্বেতপ্রিয়া হলেন। ৯৫ সংখ্যক সূক্ত থেকে জানা যায়, রাজা নহুষের স্তব-যজ্ঞে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী প্রচুর ধনরত্নের সঙ্গে ঘি ও দুধ দিয়েছিলেন। বিদ্যাদাত্রী সরস্বতী বশিষ্ঠের সময়ে সেচন সমর্থ বলবান পুত্রও দান করতেন।
এ যুগে দেখি গঙ্গার মাহাত্ম্য। বৈদিক যুগে তেমনই ছিল সরস্বতীর গুণ-কীর্তন। নদী সরস্বতী উধাও হয়েছেন। ভবিষ্যপুরাণকার বলেছেন, কলির শেষে গঙ্গাও স্বর্গে গমন করবেন। অর্থাৎ, সরস্বতীর মতো গঙ্গাও এক দিন নিশ্চিহ্ন হবেন। অনাগত কালের সেই চিহ্ন গঙ্গার বুকে যেন জেগে উঠছে। গঙ্গার সঙ্গে দূষণ শব্দটি এখন অনিবার্য।
লেখক সংস্কৃতিকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy