Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Bangladesh

এই মানুষেরা ছিলেন, আছেন

প্রতীতি দেবীর মতোই ১৯২৫-এর সন্তান ফাদার মারিনো রেগন

পিয়াস মজিদ
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২২:৪৭
Share: Save:

শতবর্ষী-প্রায় প্রতীতি দেবী চলে গেলেন সম্প্রতি, বাসভূমি ঢাকায়। তাঁর প্রস্থান মনে করিয়ে দিল সেই মানুষগুলির কথা, যাঁরা বাংলাদেশকে একটি বিশিষ্ট চরিত্র দিয়েছেন। ঋত্বিক ঘটকের যমজ ভগ্নী প্রতীতি বিয়ে করেছিলেন পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্র কবি-সাংবাদিক সঞ্জীব দত্তকে। পরিবারের বহু সদস্য দেশভাগের আগে-পরে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিলেও প্রতীতি বাংলাদেশ ছাড়েননি। তাঁর কাছে ফিরে ফিরে এসেছেন ভাই ঋত্বিক, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে প্রতীতি দেবী ও তাঁর কুমিল্লার বাড়ি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি-পরিসরে প্রতীতি আজীবন সক্রিয় ছিলেন, তাঁর কন্যা ব্যাপৃত আছেন নিরন্তর সমাজকর্মে।

প্রতীতি দেবীর মতোই ১৯২৫-এর সন্তান ফাদার মারিনো রেগন। ইটালি থেকে ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে এসে জীবনের বড় অংশ কাটিয়ে দিলেন এ দেশের বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার হলদিবুনিয়া গ্রামে। ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে প্রান্তিক মানুষের দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, চিকিৎসা-সেবা ও দুঃস্থ নারীদের উন্নয়নে তাঁর বিশেষ ভূমিকা। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন। বাংলা শিখে ইটালীয় ভাষায় অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি-সহ চল্লিশটি কাব্যগ্রন্থ, লালনের গান, জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’। অসুস্থ হলে পরিবারের সদস্যেরা তাঁকে দেশে নিতে চাইলে তিনি শর্ত বেঁধে দেন, ইটালিতে তাঁর মৃত্যু হলে মরদেহটি যেন বাংলাদেশে পাঠানো হয়। ২০১৭’য় তাঁর মৃত্যু।

১৯২৭-এ জন্ম ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজং-এর। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯-এ বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি তাঁকে সমাজসেবায় অবদানের জন্য সম্মানসূচক ফেলোশিপ দেয়। ব্রিটিশ ভারতে আদিবাসী হাজং সম্প্রদায় দিনে দিনে নিঃস্ব হয়ে পড়লে কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহের নেতৃত্বে টঙ্ক প্রথা উচ্ছেদ, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ইত্যাদি দাবি নিয়ে টঙ্ক আন্দোলন শুরু হলে কুমুদিনী তাঁর স্বামী ও ভাইদের সঙ্গে সমান বেগে এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে কুমুদিনী গ্রেফতার হন। আজন্ম যোদ্ধা কুমুদিনী বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও আজও লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন।

ময়মনসিংহে যেমন কুমুদিনী হাজং, বরিশালের মনোরমা বসুও যেন স্বদেশি আন্দোলনের উত্তাপের উত্তরবাহিকা। স্বাধীনতা আন্দোলন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ, দুঃস্থ মহিলাদের জন্য মাতৃমন্দির আশ্রম প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে সেবায় আত্মনিয়োগ, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পল্লি পাঠাগার স্থাপনের মাধ্যমে কত মানুষের ভালবাসা অর্জন করেন তিনি। ১৯৭১-এর সাহসী যোদ্ধা স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ত্রাণ, পুনর্বাসনের অসামান্য কাজ করে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবার কাছে ‘মনোরমা বসু মাসিমা’ হয়ে ওঠেন।

সিলেটের সুহাসিনী দাসও গাঁধীবাদী আদর্শের অনুসারী, মানবসেবার অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পারিবারিক সম্পদ জনকল্যাণমূলক কাজে বিলিয়ে দেন তিনি। ব্রিটিশ আমলে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন আর ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর রাজনীতি ছেড়ে সক্রিয় হন সমাজসেবায়। তাঁর সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান নিবেদিত হয়েছে উমেশচন্দ্র-নির্মলাবালা ছাত্রাবাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে।

২০১৯-এ প্রয়াত হলেন ঝর্নাধারা চৌধুরী। মহাত্মার স্মৃতিবিজড়িত নোয়াখালির গাঁধী আশ্রম ট্রাস্টের পুরোধা নারী। গাঁধীর ধর্মনিরপেক্ষ মানববাদী আদর্শের নিঃশব্দ বাহক হয়ে জীবনের এক বড় অংশ কাটিয়ে দিলেন রাজধানী থেকে দূরে, নোয়াখালিতে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘একুশে পদক’ আর ভারত সরকার ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে।

অ্যাঞ্জেলা গোমেজ় ‘বাঁচতে শেখা’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। কুমারী খ্রিস্টান মেয়েটি কোনও প্রত্যাশা ছাড়াই মাইলের পর মাইল হেঁটে কাজ করে যান বাংলাদেশে। প্রত্যাশাহীন অ্যাঞ্জেলা অবশ্য ভূষিত হয়েছেন ফিলিপিন্স-এর ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে।

গত ডিসেম্বরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজ়ড’-এর চল্লিশ বছর হল। প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি অ্যান টেলর থাকেন ঢাকার অদূূরে সাভার অঞ্চলে। ৫০ বছর আগে চট্টগ্রামে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর সেবা দিয়ে শুরু। আজ অগণিত রোগীকে সেবাদানের কর্মযজ্ঞের রূপকার তিনি।

এঁরা কেউ বাংলাদেশে জন্মেছেন, কেউ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গায় তাঁরা একনিষ্ঠ। ধর্ম বা জাতিপরিচয় তাঁদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি মোটেও। বিভিন্ন প্রান্তবর্তী অঞ্চলে, বিচিত্র ক্ষেত্রে কাজ করে তাঁরা মানুষকেই তাঁদের কাজের ‘প্রধান কেন্দ্র’ করে তুলেছেন। বাংলাদেশের সূত্রে তাঁরা ব্রত হিসেবে ধারণ করেছেন লালন ফকিরের সেই কথাখানি, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladesh Culture Pratiti Devi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy