—ফাইল চিত্র।
ওঁরা অমৃতের কন্যা। তাই সারা বছর রোদ-ঝড়-বৃষ্টি ওঁদের কাহিল করতে পারে না। নারীদিবস আসে, নারীদিবস যায় কিন্তু ওঁদের কোনও অবস্থান্তর ঘটে না। উৎসব তথা উদ্যাপন ওঁদের জন্য নয়। ওঁদের নিয়ে ভাবার সময়ই বা কার আছে! সংসারের সদস্যদের মুখে অন্ন তুলে দিতে এই দুগ্গারা কী পরিশ্রমটাই না করেন! ওঁদের কাছে অসুর হল দারিদ্র্য। যা দলন করতেই ওঁদের সারাদিনমান হাড়ভাঙা খাটুনি। ওঁরা কেউ বাসনফেরি করেন। কেউ অন্যের বাচ্চার দেখাশোনার কাজ করেন অর্থাৎ আয়া। কেউ পাড়ায় পাড়ায় শাড়ি ফেরি করেন, আবার কেউ লোকের বাড়ি বাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজ করেন। তাঁরা সকলেই নারী। স্বামী-সন্তান বা সংসারের অন্য সদস্যদের ভরণপোষণের গুরুদায়িত্ব নিজেদের কোমল কাঁধে বহন করেন তাঁরা। ‘‘এত পরিশ্রম করো কী করে?’’—এই প্রশ্নের জবাবে বাসন ফেরি করে বেড়ানো দীপালি বিশ্বাসের বক্তব্য— ‘‘ঠেলায় পড়লে সব পারা যায়।’’
সত্যিই অবাক হয়েছিলাম যে মানুষটা রবিঠাকুরের বড় বড় কবিতা গড়গড় করে মুখস্থ বলে যান কিংবা মিষ্টি গলায় কী অসাধারণ সুরে একের পর এক গান গেয়ে যান, তিনিই ওই ভারী বাসনের ঝুড়ি দুটো বয়ে নিয়ে যাবেন! এক দিন তোলার চেষ্টা করেও পরাস্ত হতে হয়েছিল। ওই রোগা অভুক্ত মানুষটা কোথা থেকে পান এমন জোর! দীপাদি কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেননি। পরিশ্রম করে রোজগার করেন। কারওর দয়ার দান তিনি নেবেন না।
বললাম, ‘‘৮ মার্চ তো নারীদিবস, জানেন কি?’’ তাঁর চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধে হল না— অর্থাৎ নারীদিবস তো তিনি কী করবেন? বললাম, নারীদিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে সুতোকলের মেয়েরা মজুরি বৈষম্য, কাজের সময় নির্দিষ্ট করা এবং কাজের জায়গায় সুষ্ঠ পরিবেশের দাবিতে প্রথম রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁদের উপরে নেমে আসে ক্ষমতাবানের দমন পীড়ন। এর অর্ধশতাব্দী পরে ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ১৯১০-এ ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় সম্মেলনটি হয়। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। সেখানে ক্লারা জেটকিন প্রস্তাব দেন ৮ মার্চ দিনটি নারীদিবস হিসেবে চিহ্নিত হোক। ১৯১৪ সাল থেকে কয়েকটি দেশ ওই দিনটিকে নারীদিবস হিসেবে পালনও শুরু করেন। অবশেষে, ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারীদিবস হিসেবে স্বীকৃৃৃৃতি দেন। শুনে দীপাদি ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বললেন— ‘‘তা হলে কি ওই দিন আমাদের কাজে না গেলেও কেউ খেতে দেবে?’’ বললাম— ‘‘নিজেদের জন্য একটা বিশেষ দিন তো পাওয়া গেল, মন্দ কী!’’
সারা রাত অসুস্থ স্বামীর সেবা করে, একটু ঘুমিয়ে নেন। তার পর সকালে রান্না-সহ যাবতীয় কাজ সেরে নিজে অভুক্ত অবস্থাতেই বেরিয়ে আসেন। সঙ্গে ভাত নিয়ে বেরোন। নদিয়ার বাদকুল্লা থেকে ট্রেনে চাপেন। তার পর মুড়াগাছা, বা কখনও দেবগ্রাম বা পলাশিতে নেমে পড়েন দীপালি। বছর পঁয়তাল্লিশের এই নারীর প্রাণশক্তি দেখলে বিস্মিত হতে হয়। না ঘুমিয়ে, না খেয়ে এত শক্তি পান কোথায়! ট্রেন থেকে নেমে কোনও একটা ছাউনি দেওয়া স্থান খুঁজে খেয়ে নেন তিনি। কোনও কোনও দিন সেটাও হয় না। ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা, যাঁরা নিয়মিত ওঁর থেকে কেনাকাটা করেন পুজোয় তাঁরা ওঁকে নতুন শাড়ি দেন। কিংবা প্রয়োজনীয় কিছু। বাড়ি ফিরে স্বামীর মুখঝামটা থেকে শুরু করে অবুঝ সন্তানের অসহনীয় আচরণ— সবই সহ্য করতে হয় তাঁকে। তা-ও আবার আর একটা নতুন ভোরের অপেক্ষায় থাকেন দীপালি। যদি কোনও নতুন বার্তা বয়ে আনে নতুন দিনটা!
পাড়ায় পাড়ায় শাড়ি ফেরি করেন সীমা মণ্ডল। তাঁর জীবনের চরম দুঃখ বাবা-মা তাঁকে পড়াশোনা শেখার সুযোগ করে দেননি। তাঁর একটি কথা বিশেষ ভাবে মনোযোগ কাড়ল। তিনি বললেন, ‘‘আমাদের ছোটবেলায় খুব অল্প দামেই ‘বর্ণপরিচয়’ পাওয়া যেত। তা-ও অভিভাবকেরা কিনে দিলেন না।’’ তাঁর আক্ষেপ বাড়ির ছেলেদের পড়াশোনার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন বাবা-মা৷ কিন্তু মেয়ের বেলায় পড়ালেনই না। অথচ, তাঁর খুব পড়ার ইচ্ছে ছিল। তাঁকেও মাত্র তেরো বছরেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দুই সন্তানকে ভাল করে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার খুব ইচ্ছে ছিল সীমার। কিন্তু বিধি বাম! মদ্যপ বাবাকে দেখে দেখে ছেলেও নেহাতই অল্পবয়স থেকেই মদ খাওয়া ধরেছে। মেয়েটাকে পরিস্থিতি বুঝে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ছেলে সম্পর্কে সীমা বললেন, ‘‘ছেলে কখনও কখনও বাবার চেয়েও পরে বাড়িতে ঢোকে মাতাল হয়ে।’’ সন্তানকে নিয়ে যে স্বপ্নটা দেখেছিলেন, তা এমন ভাবে শেষ হয়ে যাবে ভাবেননি।
রোদে পুড়ে, জলে ভিজে শরীর এখন রুগ্ণ-শীর্ণ৷ অপূর্ব সৌন্দর্যের জন্যই তাঁকে অত অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দায় সেরেছিলেন বাবা-মা। সেই সৌন্দর্য এখন হারিয়ে গিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে শাড়ি ফেরিতে যেটুকু লাভ আসে, তা-ও নাকি স্বামী সন্তানের জ্বালায় রাখার উপায় নেই। ব্যাঙ্কে একটা বই করেছেন। কিন্তু তাতেই বা কী। সে টাকাও মার উপরো জোর খাটিয়ে ছেলে তুলে নেয় প্রায়ই। ট্রেনের কামরায় অসহায় এক মায়ের মুখ, যাঁর যন্ত্রণার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই। তবুও সেই অবাধ্য সন্তান তথা সংসারের মানুষগুলোর মুখে অন্ন যোগাতে নিত্যদিন তাঁর এই ফেরির কাজ চলতেই থাকে।
কৃষ্ণনগর থেকে রোজ বহরমপুর যান রূপা সরকার। এক কর্মব্যস্ত দম্পতির ছোট্ট শিশুটিকে সামলানোর কাজ তাঁর। বাড়িতে তাঁরও ৯ বছরের মেয়ে আছে। রূপা জানালেন, ‘‘মেয়ের বাবা লরি চালায়, আমায় প্রতি মাসে সংসার খরচ এক হাজার ধরিয়ে দেয়।’’ এক হাজারে সংসার চলে? রূপা বলেন, ‘‘তাঁর আর একটা সংসার আছে, ওখানে আরও দুটো ছেলে মেয়ে আছে।’’ স্বামী নাকি ওখানেই বেশি থাকেন। রূপা আর ওর মেয়ের কাছে কম আসেন। কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘ওই বিয়েটা কি পরে করেছেন?’’ জানা গেল, ওটাই প্রথম বিয়ে। রূপার মা-বাবা ছোটবেলায় মারা গিয়েছেন। ফলে মামাবাড়িতে বড় হয়েছেন। মামাই তাঁকে ওই দোজবর দুই সন্তানের পিতার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। রূপা জানতেনই না বিষয়টা। আসলে মামার মদ্যপানের সঙ্গী ওই লরিচালক। তাই ভাগ্নিকে তাঁর হাতেই তুলে দিয়েছেন, বন্ধুত্বের বিনিময়ে।
সকালে সামান্য কিছু খেয়ে ট্রেন ধরেন রূপা। কাজের বাড়িতে গিয়ে প্রতিদিন আগের রাতের ঠান্ডা ভাত খেতে হয় তাঁকে। তাই নিয়ে মনের মধ্যে ক্ষোভ ও দুঃখও কম নেই। কিন্তু ওই বাড়িতে বলে নাকি কোনও লাভ হয় না। পুজোর ক’টা দিন ছুটি চেয়েছিলেন, তাতেও নাকি আপত্তি করছিলেন দাদা-বৌদি। অথচ তাঁর নিজেরও তো একটা সন্তান আছে। তারও তো ইচ্ছে করে মায়ের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যেতে। আসলে গরিবের শখ-আহ্লাদকে ঠিক আমল দিতে চান না সকলে। তাই রূপাদের মনকে বোঝার কোনও সদিচ্ছাও নেই তাঁদের। তাঁদের জন্য ছুটি মঞ্জুর হওয়া মানে দয়া করা, সেটা ন্যায্য পাওনা নয়।
সংসারের সদস্যদের মুখে অন্ন জোগাতে বাড়ি বাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজ করেন জ্যোৎস্না শিকদার। এক দিন পিছন থেকে হঠাৎই মোটর বাইকের ধাক্কায় কোমরে আঘাত পান তিনি। তার পর থেকেই কোমরে অসহ্য ব্যথা। তাহেরপুর থেকে ট্রেনে উঠে দেবগ্রাম স্টেশনে নেমে কিছুটা হেঁটে যাবার পথে একদিন ওই কাণ্ড। তার পর থেকে প্রায় দশ দিন আসতে পারেননি কাজে। সরকারি হাসপাতালে দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে কিছুটা ভাল হতেই আবার কাজে যোগ দিয়েছেন। বললেন, ‘‘সেনবৌদি তো না গেলেই টাকা কাটেন। আবার কেউ কেউ ভালও আছেন। যেমন বোসবৌদি।’’ তিনি নাকি এই দুর্ঘটনার পর তাঁর বাড়ি এসে হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছেন চিকিৎসাবাবদ।
জ্যোৎস্নাদির জীবনটাও বড় দুঃখের। স্বামী চেন্নাইয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে করতে একদিন সতেরোতলা ফ্ল্যাট থেকে পা হড়কে পড়ে মারা যান। তাঁর ছেলে এখন অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে পড়ছে। ছেলের খুব পছন্দের বিষয়। তিনি যদিও ঠিক বোঝেন না। তবে ছেলে তাঁকে বলেছে, অর্থনীতিতেই অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ বছরও এক বাঙালি এই বিষয়েই নোবেল পেয়েছেন। ছেলে নাকি তাঁকে বোঝাতেও চেষ্টা করে চাহিদা-জোগান নিয়ে। মা কম জানেন বলে তাঁকে কখনও তুচ্ছ করে না ছেলে। লোকের বাড়ি বাসন মেজে, ঘর মুছে, কাপড় কেচে সন্ধ্যেবেলা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে ছেলের সঙ্গে গল্প করেন তিনি। আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য দুর্গা রয়েছেন। সংসারে নিত্যকর্মের পাশাপাশি আর্থিক অনটন মেটাতে যাঁদের বাইরে বেরিয়ে কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। নারী হিসেবে অনেক রকম বাহ্যিক প্রতিকূলতা সহ্য করেও তাঁদের প্রতিদিন কাজ করে যেতে হয়। নারীদিবস এঁদেরকে সম্মান জানাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy