Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

সীতা নয়, লাঙলের ফলায় উঠে আসে মৃত্যু

১৯৬৪ থেকে ’৭৩। লাও-এর জমিতে মার্কিন বোমারু ঢেলে দিয়েছিল ২১ লক্ষ টন বোমা ও বিস্ফোরক। আশি শতাংশই ফাটেনি। আজও শিশুরা বল ভেবে লাথি মারলেই মৃত্যুমিছিল।যু দ্ধ থেমে গিয়েছে প্রায় ৪৩ বছর আগে। তবু বিস্ফোরণ থামেনি। চাষি সকালবেলায় চাষ করতে যাচ্ছেন, আচমকা লাঙলের ফলায় শক্ত কিছু বিঁধে গেল, মুহূর্তে তিনি ছিন্নভিন্ন। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রাস্তায় হুটোপাটি করতে করতে স্কুলে যাচ্ছে, কিছু বোঝার আগে প্রবল আওয়াজ, কারও হাত উড়ে গেল, কারও পা।

স্মারক। ‘থাম পিউ’ গুহার কাছে সেই গাঁওবুড়ো। ছবি: লেখক

স্মারক। ‘থাম পিউ’ গুহার কাছে সেই গাঁওবুড়ো। ছবি: লেখক

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:২১
Share: Save:

যু দ্ধ থেমে গিয়েছে প্রায় ৪৩ বছর আগে। তবু বিস্ফোরণ থামেনি। চাষি সকালবেলায় চাষ করতে যাচ্ছেন, আচমকা লাঙলের ফলায় শক্ত কিছু বিঁধে গেল, মুহূর্তে তিনি ছিন্নভিন্ন। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রাস্তায় হুটোপাটি করতে করতে স্কুলে যাচ্ছে, কিছু বোঝার আগে প্রবল আওয়াজ, কারও হাত উড়ে গেল, কারও পা। গ্রামের মহিলা ডোবায় ছিপ ফেলেছিলেন, আচমকা বিস্ফোরণে তিনি ক্ষতবিক্ষত। ১৯৭৩ সালে যুদ্ধ শেষ। তার পর ২০১০ অবধি বিস্ফোরণে ৩০ হাজার মৃত্যু, ২০ হাজার নাগরিকের পঙ্গু হয়ে যাওয়া। বিস্ফোরণ যে এই শান্তিকল্যাণে কখন কোথায় ঘটবে, কেউ আঁচ করতেও পারে না।

তাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মাঝে চিঁড়েচ্যাপ্টা একফালি দেশটার নাম লাও (ইংরেজিতে Laos)। ভিয়েতনামের মতো এই দেশটাও ছিল ফরাসি উপনিবেশ।১৯৫৪ সালে দেশ স্বাধীন হয়, ভিয়েতনামকেও সেই সময় উত্তর ও দক্ষিণে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে ভাগ করা হয়। উত্তরে হো চি মিনের কমিউনিস্ট দল, দক্ষিণে রক্ষণশীলরা। লাওয়ের কমিউনিস্ট দল ‘প্যাথেট লাও’ তখন ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, মেকং নদীর জঙ্গল ও পাহাড়ের ‘হো চি মিন ট্রেল’ বেয়ে তারা দক্ষিণের কমিউনিস্ট গেরিলাদের কাছে পৌঁছে দেয় গোলাবারুদ, বিমানধ্বংসী কামান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র।

ঠান্ডা যুদ্ধের সেই সময়টায় সাত সমুদ্র পারের ওয়াশিংটনে অন্য চিন্তা। চিন, উত্তর ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া... ঢেউয়ের মতো সবাই কমিউনিস্ট ব্লকে গিয়ে ভিড়বে নাকি? ‘ডোমিনো এফেক্ট’? সে তো হতে দেওয়া যায় না। এগিয়ে এল সিআইএ। লাওয়ের ভিয়েতনাম-লাগোয়া লং চিয়েং অঞ্চলে তৈরি হল গোপন এয়ারস্ট্রিপ। এজেন্ট অরেঞ্জ গ্যাস আর নাপাম বোমায় তখন ছারখার হয়ে যাচ্ছে সারা ভিয়েতনাম। দুটি বেসামরিক বিমান সংস্থা জানাল, ভিয়েতনাম-লাও সীমান্তে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় আটকে থাকা মানুষের জন্য খাবার ও ওষুধ নিয়ে যাবে। দুটি সংস্থাই বেনামে সিআইএ-র। ত্রাণকর্মীরা সবাই মার্কিন বায়ুসেনা।

অতঃপর ১৯৬৪ থেকে ’৭৩ অবধি লাওয়ের আকাশে মার্কিন বিমানবাহিনীর ৫ লক্ষ ৮০ হাজার ‘বম্বিং মিশন’, সকাল-সন্ধ্যা আকাশ থেকে নেমে এসেছে ২১ লক্ষ টন বোমা ও বিস্ফোরক। সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্থান-এর পরেও লাও ‘মোস্ট হেভিলি বোম্বড কান্ট্রি ইন দ্য ওয়র্ল্ড।’ টানা ৯ বছর রোজ ৮ মিনিট অন্তর বোমাবর্ষণ! আকাশ থেকে পড়া বিস্ফোরকগুলি ‘ক্লাস্টার বম’। পাশাপাশি জোড়া ধাতব কেসে ইস্পাতের বল বেয়ারিং। প্রায় ৮০ শতাংশ বিস্ফোরকই তখন ফাটেনি। আজ জমিতে চাষির লাঙলে বিঁধে গেলে বা মাঠে বাচ্চা ছেলে নতুন বল ভেবে লাথি মারলেই মৃত্যুমিছিল।

গিয়েছিলাম লং চিয়েং-এর ফনসোভান। গোপন এয়ারস্ট্রিপ তৈরি হয়েছিল যেখানে। কাছেই ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ সাইট: প্লেন অব জারস। তিনটি উপত্যকা জুড়ে ছ’-সাতশো কেজির সব পাথুরে কলসি, সবচেয়ে বড়টা প্রায় ৬ টন। ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি প্রাগৈতিহাসিক সমাধিস্থল। ওই কলসিতেই রাখা হত চিতাভস্ম। সারা জায়গা জুড়ে নোটিস বোর্ড: সাদা তিরচিহ্নিত এলাকায় থাকুন, ওখানে ‘ইউএক্সও’ (‘আনএক্সপ্লোডেড ডিভাইস’ বা না-ফাটা বিস্ফোরক) সাফ করা হয়েছে। বাকি জায়গায় বিস্ফোরক থাকতে পারে। এই বিশ্ব-ঐতিহ্যের মাঝেই উল্টে রয়েছে মরচে-পড়া সোভিয়েত ট্যাঙ্ক। মস্কো ট্যাঙ্ক পাঠিয়েছিল, কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে নয়। প্রশিক্ষিত ট্যাঙ্কচালকের বদলে প্যাথেট লাও-এর গেরিলারাই সে দিন ট্যাঙ্কে মেশিনগান নিয়ে। আচমকা নেমে-আসা বোমা রেহাই দেয়নি তাদের।

কলস-উপত্যকার উল্টো দিকে ৫০ কিমি গেলেই ‘থাম পিউ’ গুহা। একটা ঝর্নার পাশ দিয়ে পাহাড়ি চড়াই ভাঙতে হয়, সামনে কালো পাথরে তৈরি গাঁওবুড়োর মূর্তি, তাঁর কোলে নেতিয়ে পড়া বালকের মৃতদেহ। বিমানহানা থেকে বাঁচতে প্রায় ৩৭৬ জন আশ্রয় নিয়েছিল চুনাপাথরের এই বিশাল গুহায়। আশ্রয়-নেওয়া মানুষগুলি গুহার এক দিকে তৈরি করেছিল চিকিৎসার মেক-শিফ্ট হাসপাতাল, আর এক পাশে শিশুদের পাঠশালা। বিমান হানা তখন চলছে, আরও নিরাপদ গুহার খোঁজে সকালে বেরিয়ে পড়েছিল অভিজ্ঞ দুই গাঁওবুড়ো। দিনটা ১৯৬৮ সালের ২৪ নভেম্বর। দুপুরেই দুটি মার্কিন ফাইটার বিমান গুহার মুখে ক্লাস্টার বোমা ছুড়ে দেয়। তাদের ধারণা, কমিউনিস্ট গেরিলারা এই গুহায় আশ্রয় নিয়েছে। দুই গাঁওবুড়ো যখন ফিরল, ভিতরে পরস্পরকে জড়িয়ে শুয়ে ৩৭৪টা মৃতদেহ। নারী শিশু কেউ বাদ যায়নি। এবড়োখেবড়ো পাথর পেরিয়ে ভিতরে গেলে অন্ধকার বিশাল হাঁ-মুখ। বাইরে বুদ্ধমূর্তির সামনে কেউ কেউ জ্বালিয়ে দিচ্ছেন প্রদীপ। ২৪ নভেম্বর এখানে জাতীয় স্মরণ দিবস।

একুশ শতকের লাও হতদরিদ্র কমিউনিস্ট দেশ, ১৮২টা দেশের মধ্যে মানব-উন্নয়ন সূচকে ১৩৮ নম্বরে। পাহাড়ি জঙ্গুলে ভূমিতে কৃষিযোগ্য জমি ৯ শতাংশ। অর্ধেকই বিমান থেকে ফেলা ‘ইউএক্সও’ অধ্যুষিত। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে বিস্ফোরক খুঁজে, নিষ্ক্রিয় করে জমি পরিষ্কারের পর কৃষি, নগরায়ণ, রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুল, বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি, সব কিছুর খরচ লাফিয়ে বেড়ে যায়। এবং, দেশের বেশির ভাগই জঙ্গল, সেগুলি ‘ইউএক্সও’ মুক্ত করা ‘কস্ট এফেক্টিভ’ নয়।

শিশুরা এ দেশে নিরন্তর বলি। কারও বাবা চাষ করতে গিয়েছেন, আচমকা অঙ্গহানি বা মৃত্যু। নেট ফল, অর্ধেক শিশু অপুষ্টির শিকার। আরও বড় বিপদ আছে। নিষ্ক্রিয় বোমার ধাতব খোলস থেকে অনেকে কাঁটা-চামচ আদি সুভেনির তৈরি করে। অনেক গরিব শিশু মা-বাবাকে সাহায্য করার জন্য শস্তার মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে ক্লাস্টার খোল খুঁজতে যায়। বোমা ঠিকঠাক নিষ্ক্রিয় হয় না, হতাহতের সংখ্যা বাড়ে। গত ক’বছর ধরে যে সব আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এখানে ইউএক্সও পরিষ্কারের দায়িত্বে, তারা অবশ্য নতুন একটা বুদ্ধি নিয়েছে। ইউএক্সও খোঁজা ও নিষ্ক্রিয়করণের দায়িত্বে পুরোপুরি মেয়েদের স্কোয়াড। পরিবারের কর্তার অঙ্গহানি হলেও গ্রামের বউটি কাজ পাচ্ছেন, ছেলেপুলেদের না-ফাটা বোমার খোল নিয়ে সতর্কও করতে পারছেন।

সুপারপাওয়ার দাদারা এই ক্লাস্টার বোমার ব্যথা বোঝে না। একদা ইউরোপে যুদ্ধের পরও ল্যান্ডমাইনে অনেক নিরীহ নাগরিকের প্রাণ যেত। অনেক দেশই আজ তাই মাইন ব্যবহার না করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এমনটা কি ঘটতে পারে না বিমানহানার ক্ষেত্রেও? কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি ১০৮টি দেশ বছর চারেক আগে ‘কনভেনশন অন ক্লাস্টার মিউনিশনস’ চুক্তিতে সই করে জানিয়েছে, ক্লাস্টার বোমা তৈরি ও তার ব্যবহার থেকে তারা বিরত থাকবে। আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ইজরায়েল এবং ভারত সই করেনি। তাদের বক্তব্য, ভবিষ্যতে শত্রুরা বেসামরিক নাগরিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, একটি সাধারণ বাড়ির ছাদেও তখন হয়তো সামরিক টার্গেট দেখা দেবে, সে সময় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে তাতে বরং অনেক বেশি সংখ্যায় মানুষ হতাহত হবেন। ক্লাস্টার বোমা সেই তুলনায় ‘মানবিক’। সে নির্বিচারে সব কিছু ধ্বংস করে দেয় না।

সাড়ে চার দশক ধরে হাত-পা উড়ে যাওয়া গরিব লাও শিশুরা ‘মানবিক’ অস্ত্রসম্ভারের এই পৃথিবীতে তাই নিতান্ত কোল্যাটারাল ড্যামেজ!

অন্য বিষয়গুলি:

laos gautam chakraborty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE