দুটো শব্দবন্ধ ফিরে ফিরে ব্যবহার হয়। ‘নো-হাউ’ আর ‘নো-দ্যাট’— জানার রকমফের। কখনও জানার ব্যাখ্যা হয় বোঝা, কখনও বা শেখা। শেখা কথাটার মধ্যে হাতেকলমে শিক্ষানবিশির ইঙ্গিত থাকে। কোনও বিষয় শুধু বোঝার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহারিক শিক্ষণের দরকার পড়ে না।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বলে, উচ্চশিক্ষার পথে বেছে নিতে হবে জানার যে কোনও একটা পথ। ধরা হয়, যে মানুষ কর্মদক্ষতা বা ‘স্কিল’ নিয়ে মাথা ঘামান, তাঁর পড়া উচিত ইঞ্জিনিয়ারিং, তার পর ম্যানেজমেন্ট। এই দক্ষতা সমাজপ্রকল্পে কাজে লাগে। আর কিছু ছাত্র থেকে যান, যাঁরা চান জানতে, বিষয়গুলো বুঝতে। প্রয়োগের উপকারিতা নিয়ে মাথা ঘামান কম। চিরাচরিত সমীকরণে এই দলের ঠাঁই হয় হিউম্যানিটিজ় বা ন্যাচারাল সায়েন্সেস-এ। যাঁরা এই দুইয়ের মাঝামাঝি ইচ্ছে নিয়ে জীবনে এগোতে চান, তাঁদের জন্য থাকে বিহেভিয়রাল সায়েন্স-এর কিছু বিষয়। স্কুল থেকে কলেজে ওঠার সময় বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যের ইচ্ছে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে অনেক বাদানুবাদ শোনা যেত এক সময়ে। এখন সমীকরণের ধারণা এত গভীর ভাবে আস্তানা বেঁধেছে আমাদের মননে যে, ছাত্রদের সংশয়ের বিশেষ অবকাশ দেওয়া হয় না। পড়াশোনা আর উপার্জনের সহজ একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়ে আছে। ফলে বিষয় বাছার কাজেও আজকাল আর তেমন ভাবনার প্রয়োজন হয় না। ছক বাঁধাই আছে।
সমস্যা হয়, যখন এই ধারণা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে এসে হোঁচট খেতে খেতে মনে হয়, আরও কিছু বিষয় জানা দরকার ছিল। কাজের চাপে আর নতুন করে কিছু করা হয়ে ওঠে না হয়তো। ম্যানেজমেন্ট কর্মীরা বলেন তাঁদের সমাজ, সাহিত্য, মনস্তত্ত্ব বোঝার প্রয়োজন। না বুঝে কাজ চলে না, এমন নয়। কিন্তু জানলে উৎকর্ষের ফারাক হয় বইকি। উল্টো দিকে, কেমন হয় তাঁদের জীবন, প্রয়োগের দিকে বিশেষ মনোযোগ না দিয়ে যাঁরা মন দেন বিষয়ের গভীরতায়? তাঁরা পড়াতে আসেন, নীতি নির্ধারণের কাজ করেন, লেখেন। ভাবাটাই তাঁদের পেশা হয়। অনেক সময়ে এই ভাবনাগুলো সামাজিক লাভ-ক্ষতি থেকে এতটাই দূরে সরে থাকে যে, গভীর দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় জীবনের সঙ্গে। মনে করিয়ে দেয় অনন্ত কালের সেই প্রশ্ন— কী ভাবে জানব? ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে না যৌক্তিক বিবেচনায়? যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে? না কি এই দুইয়ের উপর একসঙ্গে ভরসা করে দেখা যেতে পারে?
এ সব এখন আরও ভাবাচ্ছে, কারণ কাজের জায়গাগুলোয় ক্রমাগত কর্মীর চাহিদা কমছে। আগামী ছ’-সাত বছর কলেজ-ইউনিভার্সিটির ও-পারের কঠিন জীবনযুদ্ধ আরও কঠিন হতে পারে। নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হলে পরিশ্রম আর মেধা ছাড়াও দরকার হবে, জানার ব্যাপ্তি। প্রাচীন গ্রিসে লেখাপড়ার একটা বিশেষ ধরন ছিল। পরবর্তী কালে আমেরিকান হাই স্কুল আর কলেজ সেই ধারণাটিকে এতই সাদরে আপন করেছে যে, এখন তাকে আমেরিকান বলে ভ্রম হয়। ভ্রম বলা ঠিক নয়। গ্রিক পদ্ধতিনামার চেহারাটার অনেক বদল ও বিস্তার হয়েছে সময় আর মহাদেশের পারান্তরে। ‘লিবারাল আর্টস এডুকেশন’ নামে শিক্ষাপদ্ধতির অর্থ, বিস্তার আর উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের এই আলোচনা।
লিবারাল আর্টস— এক জোড়া শব্দ। বিশ্লেষণ না করলে আধুনিক ভাষার জটিলতায় অর্থচ্যুতি হওয়ার ভয়। ‘লিবারাল’ কথাটি এসেছে ‘লিবারালিস’ থেকে, যার অর্থ হল মুক্ত। এ ক্ষেত্রে ‘আর্ট’ মানে একটি বিষয় ঘিরে দক্ষ (স্কিলড) এবং নিয়মানুগ (সিস্টেম্যাটিক) চর্চা। বিদ্যাচর্চার বিশেষ এই কলার অধিকারী হতে হলে প্রথমেই চাই একটা মুক্ত মন। যে মন— শিখব কিন্তু ভাবব না বা শুধুই ভাবব, বিষয়টাকে কী ভাবে ব্যবহার করব, এই নিয়েই ভাবব না, এমন দ্বিত্ব-র ফাঁদে পড়েনি। চাই মুক্ত অঙ্গন। এমন একটা শিক্ষার পরিকাঠামো যেখানে ক্লাস টেন-এর পরে বলে দেওয়া হবে না যে, অঙ্কের সঙ্গে ইতিহাস পড়া যায় না বা যিনি পদার্থবিদ্যা নিয়ে এগোবেন তাঁর পক্ষে বিশ্বসাহিত্য নিয়ে মাথা ঘামানো মানে সময়ের অপব্যবহার। শিখতে হবে, বুঝতে হবে— দর্শন, ব্যাকরণ আর অলঙ্কারশাস্ত্র। কাঁচাবেলায় ভাষার কৌশল ঠিক ঠিক মাপে মিশলে সমাজকে পড়া সহজ হয়। যুক্তিভাবনা-চিন্তা যাকে ‘ক্রিটিকাল থিঙ্কিং’ বললে চিনতে সুবিধে হয়, তার সঙ্গে যদি পরিচয় না থাকে, তা হলে রাষ্ট্রের বিপত্তি। সে রকম হলে গণবাদী রাষ্ট্রের নাগরিকের থেকে বিবেচনার আশা করা বাহুল্য।
এই তিনটি বিদ্যা— দর্শন, ব্যাকরণ আর অলঙ্কারশাস্ত্র, ইউরোপীয় শিক্ষার আঙিনায় এদের একসঙ্গে বলা হত ‘ট্রিভিয়াম’, যার চর্চা ‘লিবারাল আর্টস’-এর প্রথম নুড়ি। মধ্যযুগের ইউরোপে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা হচ্ছে, মনে করা হল যে ছাত্রদের প্রকৃতি আর সমাজ চেনানোর জন্য আরও কিছু বিষয় চাই। তিন মহাবিদ্যার সঙ্গে জোড়া হল আরও চার শাস্ত্র (কোয়াড্রিভিয়াম)— পাটিগণিত, জ্যামিতি, সঙ্গীত, জ্যোতির্বিদ্যা। এই সাতের মৌলিক সমাহার ঘটল লিবারাল আর্টস এডুকেশন-এর আধারে। ট্রিভিয়াম-এর পাঠ ছাত্রদের শেখাত কী ভাবে জানতে হয়। কোয়াড্রিভিয়াম-এ সেই ছাত্রের সামনে পরতে পরতে খুলে যেত জীবনচর্চার বিন্যাস। তাঁরা প্রাণী-তত্ত্ব বুঝছেন, কবিতার ছন্দ ভাঙছেন গড়ছেন। সামাজিক কাঠামো, রাষ্ট্র, আইন নিয়ে কথা বলছেন। প্রশ্ন করার জন্য যে ভাষা আর যুক্তি প্রয়োজন, এ সময়ের ইউরোপে তা কম ছিল না। ভারতেও কি এমন চর্চা ছিল না? নালন্দা, তক্ষশিলায় দেশান্তর থেকে আসতেন ছাত্ররা। লিবারাল আর্টস-এর ছাঁচে লেখাপড়া হত এ দেশেও।
প্রসঙ্গত, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাকাঠামো বদলের যে নীতি তৈরি করেছে, তার আপাত চেহারা যেন একটু মিলে যাচ্ছে লিবারাল এডুকেশন-এর ধারণার সঙ্গে। তবে ধারণার সঙ্গে ছায়ার মিল থাকলেই তার বিস্তার সন্দেহের ঊর্ধ্বে হয় না। দেশের দেড়শো বছরের লেখাপড়ার গভীর শেকড় আচমকা উপড়ানোর উদ্দেশ্য বিষয়ে বিভ্রান্তিটা জাগছেই। আমেরিকান এডুকেশন-এর নিছক অনুকরণ, না সার্বিক মানের উত্থান, না কি অন্য কিছু, বদলের কারণটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। পঠনপদ্ধতি নিয়ে রাজনীতি এ দেশে প্রাত্যহিক বাস্তব। সে সব বিচারের জন্যও শিক্ষাভাবনার ইতিহাস বোঝা প্রয়োজন।
আজকাল বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের নিরন্তর ঘিরে রাখছে তীব্র সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। এর থেকে উত্তরণ হয়তো সম্ভব, যদি আমাদের বোধের কেন্দ্র থেকে সমূলে তাড়িয়ে দেওয়া যায় কিছু কুসংস্কারমূলক দ্বিত্ব-র ধারণা। ইদানীং কালে বৃহত্তর গবেষণার বিষয়গুলো পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে এগোয়, একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে। একটি বইয়ে ‘ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া’-র অধ্যাপক এবং আরণ্যক বাস্তুতত্ত্ববিদ সুজ়ান সিমার্ড লিখছেন, বনের সব গাছ একে অন্যের উপর নির্ভর করে বাঁচে। আগাছা ছাড়া বড় গাছ বাঁচে না। সিমার্ড নিজে কাঠুরের মেয়ে, তাঁর গবেষণা বলে, এক দল ছত্রাক একটা গাছের শেকড় থেকে খাবার নিয়ে অন্য গাছের শেকড় পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে। এই নিয়ে সুজ়ান তৈরি করছেন ‘মাদার ট্রি’ বলে একটা ধারণা। বলছেন, কিছু গাছ বা গাছালি মায়েদের মতো হয়, তারা অন্যদের লালন করে। এই যে বিষয়টি, একে আমরা কী নামে ডাকব? বিজ্ঞান তো নিশ্চয়। কিন্তু বিজ্ঞানকে আগলে আছে একটা দর্শনবোধ, যা সম্ভবত তৈরি হয়েছে সুজ়ান-এর ওই কাঠুরে পরিবারে বড় হওয়ার সময়ে। তাঁর জীবনবোধের ইতিহাসকে যখন তিনি বিজ্ঞানচর্চায় সাজাচ্ছেন, সেই প্রক্রিয়াকে গতানুগতিক প্রযুক্তিবিজ্ঞানের আওতায় ফেলা মুশকিল নয় কি? আসলে ভাষা, নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনস্তত্ত্ব এই সব ক’টি বিষয়ের চশমা পরে যদি জীবন আর যুগকে দেখা যায়, তা হলে অবশ্যই এমন ভাবে বলতে পারা সম্ভব। এই বিবেচনার প্রণালী শিখে নেওয়ার সময় এসেছে এখন।
জরাধরা বাঁধ ভাঙতে হবেই, কিন্তু তার আগে বুঝতে হবে যে, কেন ভাঙছি। এই ভাঙনের ও-পারে কি আবার আসবে বিভ্রম আর বিশৃঙ্খলা? এই বিভ্রান্তি চেনার মাধ্যম হতে পারে লিবারাল আর্টস-এর বিস্তীর্ণ জমি। স্নাতক পর্যায়ে নতুন কিছু ভাবার দরকার নেই। কিন্তু যত্ন করে শেখা দরকার, কী করে ভাবতে হয়, আর ভাবনাগুলো পারিপার্শ্বিকের প্রয়োজনে কেমন করে ব্যবহার করতে হয়। পরিচিত মূল্যবোধের পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে যুঝতে গেলেও দ্বন্দ্বের ইতিহাস পড়তে হবে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শিখতেও মনের অগোছালো কুঠুরিগুলো নিয়ে পড়তে হবে। সব বিষয় খুব চৌকস ভাবে পড়তে হবে, ‘লিবারাল আর্টস’ তা বলে না, কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিষয়গুলোর মিল-অমিল চেনার মতো একজোড়া চোখ তৈরি করে দিতে চায়। লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চি বিষয়ে হিউম-এর স্বগতোক্তি মনে পড়ে— অ্যানাটমি-র বোধ ছাড়া কি ভাস্কর হওয়া যায়?
এ দেশে গত দশ-বারো বছরে নানা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এই নিয়ে ভাবছে। বলছে, বিশ্বায়নের উপার্জনের পাথেয় হিসেবেও এই মাধ্যমকে বেছে নেওয়া উচিত। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে লিবারাল আর্টস পড়া ছেলেমেয়েদের প্রতি পক্ষপাতী কেন নানান বড় মেজো সংস্থা? দরকারি প্রশ্ন। জিজ্ঞাসার ব্যাপ্তি, বিচার, প্রয়োগ— এক আধারে সবটা পাওয়ার জন্য যে নকশা, তার গুরুত্ব নিয়ে ভাবা জরুরি হয়ে উঠছে।
লিবারাল আর্টস বিভাগ, কর্ণাবতী ইউনিভার্সিটি, গাঁধীনগর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy