বাদামি ধূসর লোমে আবৃত ‘হিসপিড’ খরগোশ (‘মাথা ঠুকে মরবে, তবু বশ মানবে না,’ রবিবাসরীয়, ১৭-৫) পুরুলিয়ার অযোধ্যা-সংলগ্ন গভীর বনাঞ্চলে এখনও রয়েছে। চোরাশিকারিদের কল্যাণে মাঝে মাঝে তার প্রমাণ মেলে। ওদের মুখ থেকেই শোনা, এই খরগোশরা খুব ভিতু এবং লাজুক প্রকৃতির হয়। আওয়াজ পেলেই দৌড়ে পালায়, পিছন ফিরেও তাকায় না। তার পর মাটিতে মাথা গুঁজে মুখটা লুকিয়ে রেখে বড় বড় লম্বা কান দুটো খাড়া রাখে। এরা নাকি এতই লাজুক যে এদের জোড়ায় জোড়ায় কখনও দেখতে পাওয়া যায় না। এই ধরনের খরগোশকে আমরা আঞ্চলিক ভাষায় ‘খেড়া’ বলি। শোনা যায়, পুরুলিয়া জেলার জঙ্গলমহল এলাকার বিশেষ এক সম্প্রদায়ের মানুষ খেড়া শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। তাই তারা ‘খেড়িয়া’ জনজাতি নামে আজও পুরুলিয়ায় পরিচিত। শবরদের মতো এরাও নাকি ব্যাধ সম্প্রদায়।
খেড়ার মূল খাদ্য বনের কচি ঘাস, মিষ্টি ফল ও গাছের মূল। বসন্ত ও গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় মহুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে মহুল ফল খাওয়ার জন্য গভীর নির্জন রাতে গাছের তলায় আসে এবং চোরাশিকারিদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে মারা পড়ে। পর দিন চোরাশিকারিরা বস্তায় লুকিয়ে গ্রামের বাজারে দুই-আড়াই কেজির খেড়া পুলিশ ও বনকর্মীদের ভয়ে জলের দরে বিক্রি করে চলে যায়। শিকারিদের মুখ থেকেই শুনতাম, খেড়াদের জীবন্ত অবস্থায় কখনও ধরা যায় না। এখন বুঝতে পারা যাচ্ছে, জালের ফাঁদে পড়লেই এরা মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করে মাথা ঠুকে, রক্ত ঝরিয়ে মৃত্যু বরণ করে, বা জালের সুতোতে জড়িয়ে আত্মহত্যা করে। তবু কারও কাছে আত্মসমর্পণ বা বশ্যতা স্বীকার করে না। বর্তমানে বৃক্ষনিধন, বন্য পশু নিধন আর দাবানলের দাপটে এরা আপাতত দ্রুত বিলুপ্তির পথে।
তপনকুমার বিদ
বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
সদাজাগ্রত
রুদ্রজিৎ পাল (‘অন্তরের উপনিবেশ’, সম্পাদক সমীপেষু, ২৭-৬) আফ্রিকাবাসীদের দেহাবয়ব আর ত্বকের রং নিয়ে আমাদের গর্বের সাহিত্যে সাহিত্যিকদের অন্তরের চেহারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকাবাসীদের প্রতি পশ্চিমি শ্বেতাঙ্গদের মনোভাব আমাদের মধ্যে চারিয়ে আছে বলেই আজও আমরা আন্দামান বেড়াতে গিয়ে জারোয়াদের দেখার তীব্র ইচ্ছে মনের মধ্যে পোষণ করি। এ সবের পিছনে সম্ভবত কাজ করে আর এক বর্ণ-বৈষম্য যা আমাদের সমাজ হাজার হাজার বছর ধরে লালন করে এসেছে। তবু বলব আমাদের মধ্যেই এমন এক ব্যক্তিত্ব আছেন, যিনি নির্ভয়ে আফ্রিকার অধিবাসীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে লিখতে পেরেছেন, ‘‘সভ্যের বর্বর লোভ/ নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।/ তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে/ পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে;/ দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়/ বীভৎস কাদার পিণ্ড/ চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।’’
তিরাশি বছর আগে এই কবিতা লিখছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর মৃত্যুর চার বছর আগে। আমরা অনেকেই ‘আফ্রিকা’ কবিতাটা পড়েছি, মঞ্চে আবৃত্তি করেছি। কিন্তু কথাগুলো আত্মস্থ করতে পেরেছি কি?
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা-১০৪
ফর্সার পুজো
কালো নিয়ে চির কালের সমস্যা আমাদের। এই বিশ্ব পণ্যের বাজারে মেয়েরা পায়ে পা মিলিয়ে কাজ করলেও সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যক্তিত্বকে প্রাধান্য দিয়ে উঠতে পারে না যেন আজও।
পুরাণে কথিত কালীকেও মহাদেব সবার সামনে ‘কালী’, ‘কালী’ ডেকে অপমান করেন। দেবী তপস্যাবলে কৃষ্ণ কোষ ত্যাগ করে গৌরী হন আর সেই কোষ থেকে দেবী কৌষিকীর জন্ম। তিনি আবার একলা থাকেন, বিবাহ করেন না— প্রভূত শক্তির অধিকারিণী। কালো বলেই কি দেবসমাজে ব্রাত্য! দ্রৌপদী মহাভারতের অন্যতম নারী চরিত্র, কৃষ্ণের সখী। সেই কৃষ্ণা কিন্তু শ্যামা। চরিত্রটি এত উজ্জ্বল, তাঁর মহিমায় আমরা মুগ্ধ। পঞ্চস্বামীকে উজ্জীবিত করা, কুরুক্ষেত্রে পাঁচ পুত্রের বলিদান, আবার কৃষ্ণের মতো সখা পেয়েও নিজ চরিত্রে গরীয়সী এই নারীকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারি না। ইনিও কিন্তু ‘কালো’ই। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের স্ত্রী নির্মলকুমারীকে নিয়েও রবীন্দ্রনাথকে ঠাট্টা করতে শুনি আবলুশ কাঠের হাতি কেনা নিয়ে। তিনিই আবার কবিতায় কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ আঁকেন। বিপাশা বসুর কালো রং তাঁর যৌন আবেদন হয়ে ওঠে, এ দিকে তাঁর ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা চাপা পড়ে যায়। নন্দিতা দাশ, পাওলি দামের মতো প্রতিভাদের আমরা গায়ের রং দিয়ে চেপে রাখতে পারি না, অথচ ঘরের মেয়ে বিবাহযোগ্যা আর কালো হলে বিপদে পড়ি। তাকে এত কু-কথা শোনাই, যাতে সে নিজেকেই অপরাধী ভাবতে শুরু করে। এখনও কেন এই অপরাধ বোধ তৈরি হবে, কেন বাড়তি পণ দাবি করবে পাত্রপক্ষ?
ত্বকের বর্ণ স্থির করে মেলানিন নামক রাসায়নিক। সেই সামান্য রাসায়নিক আজ লক্ষ লক্ষ মেয়ের ভাগ্যবিধাতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাজারচলতি স্টেরয়েড-যুক্ত চটজলদি ফর্সা হওয়ার ক্রিম মেখে আরও বড় ক্ষতির দিকে এগোচ্ছে তারা। আমরা বদলাচ্ছি না। গয়নার বিজ্ঞাপনে কালো মেয়ে দেখে এক বয়স্ক মাসিমা সে দিন খুবই দুঃখপ্রকাশ করলেন, যেন গয়নাগুলোকেই নষ্ট করা হয়েছে। তাঁদের বাড়িতে আবার কালীপূজা হয়। দেবতার অধিষ্ঠান কি শুধু মূর্তিতে? জিজ্ঞেস করতে রুচিতে বাধল। মনে মনে সেই ঘোর কালো নারীমূর্তিকেই প্রণাম জানালাম।
রাখী মিত্র চক্রবর্তী
জয়নগর-৭৪৩৩৩৭
সরব এঁরাও
‘অন্তরের উপনিবেশ’ চিঠিটির সঙ্গে আরও কিছু তথ্য যোগ করতে চাই। জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনার বহু পূর্বেই বিশ্বের সাহিত্য সমালোচকরা সাহিত্যে কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রগুলিকে বীভৎসতার প্রতীক হিসাবে বর্ণনা করার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। এই বিষয়ে ফ্রেডরিক জেমসনের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য পলিটিক্যাল আনকনশাস’ বইতে জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ উপন্যাসটিকে ‘বর্ণবিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়েছেন। কারণ তাতে আফ্রিকার মানুষদের অমানুষ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আফ্রিকার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সমালোচক চিনুয়া আচেবে (১৯৩০-২০১৩) ওই উপন্যাস এবং ওই ধরনের অন্যান্য উপন্যাস সম্বন্ধে বলেছেন, ওগুলি পড়লে আফ্রিকার মানুষ সম্পর্কে ঘৃণার উদ্রেক হয়।
বিশ্বের বহু সমালোচক কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্র নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলির ব্যাপারে একই মত পোষণ করেন। এই ধরনের দুটি বিখ্যাত উপন্যাস— মার্ক টোয়েনের ‘হাকলবেরি ফিন’ এবং ই এম ফরস্টারের ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’, যা নিয়ে বিরূপ সমালোচনা অন্তহীন।
শ্রীশঙ্কর ভট্টাচার্য
কলকাতা-৩৯
কৃষ্ণাঙ্গী নয়
সোনালী দত্ত (‘শব্দে নয়, অর্থে বদল চাই’, ৩০-৬) শেক্সপিয়রের ‘সনেট ১৮’-এর উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘পৃথিবীর সেরা সনেটিয়ার এক মহিলাকে নিয়ে কবিতা লিখছেন, অথচ তাঁর গায়ের রং সাদা নয়।’’ তথ্যটি অসম্পূর্ণ এবং ঠিক নয়। শেক্সপিয়র মোট ১৫৪টি সনেট লিখেছেন। প্রথম ১২৬টি সনেট এক জন ‘ফেয়ার ইয়ুথ’-কে নিয়ে লেখা। পরবর্তী সনেটগুলি (১২৭-১৫২) ‘ডার্ক লেডি’ অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণের এক মহিলাকে নিয়ে লেখা। রোমান পৌরাণিক কাহিনির চরিত্র কিউপিড-কে নিয়ে শেক্সপিয়র তাঁর শেষ দুটি (১৫৩-১৫৪) সনেট লিখেছিলেন।
তাই শেক্সপিয়রের ‘সনেট ১৮’ কৃষ্ণবর্ণের মহিলাকে নিয়ে লেখা নয়, তাঁর ‘ফেয়ার ইয়ুথ’-কে নিয়ে লেখা সনেটগুলোর অন্তর্গত।
অনিমেষ দেবনাথ
নাদনঘাট, পূর্ব বর্ধমান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy